Monday, June 24, 2013

আত্মকথনঃ ২

২০০০ সালের শেষের দিকের ঘটনা সম্ভবত। দিনটি ছিল সদ্য গ্রাজুয়েশন শেষ করে কোন এক বড়ভাইয়ের মালয়েশিয়ার পার্ট চুকিয়ে দেশে ফিরে যাবার পালা। তখন কুয়ালালামপুর থেকে ঢাকা আসার তিনটি এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ছিল। এমিরেটস (দুবাই ভিত্তিক), বিমান এবং মাস (মালয়েশিয়ান)। যাহোক সকালের দিকে ভক্ত এক জুনিয়র এসে হাজির।

জিজ্ঞেস করলো, “বস, সি-অফ করতে যাবেন না?”
আমি বললাম, “যাবো, কিন্তু তার আগে ঘটনা আছে...।”
“আবার কি ঘটনা?”
“আগে খবর নে কোন এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট?”
“আরে বস, সেই খবর আগেই নিছি...এমিরেটস”
“তাইলে যাবো......কিন্তু মামা, মিনিমাম ৩ ঘণ্টা আগে যাইতে হবে যদি এমিরেটসের মাল দেখতে চাও”
“কন কি বস, এয়ারহোস্টেজরা এতো আগে চলে আসে?”
“হুম”

যাই হোক, বিকাল বেলা আনুমানিক ৪ টার দিকে পরিকল্পনা মোতাবেক আমরা বেশিরভাগ বাংলাদেশী ছাত্ররা কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে হাজির। আমার পরনে জিন্স-টি শার্ট। আমি সেই জুনিয়র ছেলেকে পাঠালাম বাইরে গিয়ে দাড়াতে। এমিরেটসের স্টাফ বাস আসলেই খবর দিবি। দেখি বড়ভাই কাগো সেবা লইতে লইতে বাংলাদেশে যায়। এইফাকে বিদায়ী বড়ভাই গেল চেক ইন করাতে। চেক ইনের জন্য ২ লাইন। লাইন অনেক লম্বা। বাংলাদেশীদের জন্য একটি। অপরটি আরবদের জন্য যারা ঢাকা হয়ে দুবাই যাবে।

হঠাৎ করে চোখ আটকে গেলো একটি আরব দম্পতির দিকে। অন্যান্য তথাকথিত আধুনিক আরবদের থেকে অনেক আলাদা। আমদের ইউনিভার্সিটিতে অনেক আরবদেরকে দেখেছি ঈমানের দুর্বলতার কারনে সীমাহীন স্বাধীনতার খোজে উশৃংখল জীবন যাপন করতে। পুরুষটি সাদা লম্বা পোশাক পড়া কিন্তু টাকনুর উপরে। মুখে সুন্নতি কালো দাড়ি। মাথায় সাদা রুমাল পাগড়ির মতো করে বাধা। পাশেই তার স্ত্রী কালো বোরকা পড়া, শুধু চোখ দেখা যাচ্ছে। কোলে শিশু সন্তান। আরেকটু খেয়াল করে দেখলাম মহিলাটি কালো হাত মোজা পরিহিত। পুরা দম্পতির আউটলুকের মধ্যেই একটা বিনয়ের ছাপ।

আমি যেন নিজের অজান্তেই ডুবে গেলাম অন্যরকম ভাবনায়। হঠাৎ করেই মনে হল এরাও মুসলমান আর আমিও মুসলমান। কি সুন্দর লাগছে? দূর থেকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে একটি সত্যিকার মুসলমান দম্পতি। আচ্ছা আমিও তো মুসলমান...আমাকে আর আমার ভবিষ্যৎ স্ত্রী সন্তানকে কি এরকম দেখা যাবে? কিন্তু আমার যে হাল ...আমাকে কিভাবে এই রকম বোরকা পড়া তার উপরে কালো হাত মোজা পরিহিত মেয়ে বিয়ে করবে? মেয়ের মাথা খারাপ না তার বাপের? আর তাছাড়া আমি হলো বিয়ে করবো অত্যন্ত আধুনিক মেয়ে......বন্ধুরা আলোচনা করবে......রিইউনিয়নে জুনিয়ররা আলোচনা করবে...... “বেগ ভাই, কি আগুন নিয়া আইছেড়ে লগে?” আবার মনে হল, আরে আল্লাহ চাইলে তো হতেও পারে......।

এর মাঝেই সেই বাইরে দাড় করিয়ে রাখা সেই ছেলে হাজির, “বস, মাল হাজির...।” আমি রেগে গিয়ে বললাম, “যা, ভাগ এখান থেকে...”। ও অবাক হয়ে বলল, “আরে আপনিই তো এই লোভ দিয়ে আনলেন...”। যাই হোক, বড় ভাইকে বিদায় দিয়ে ক্যাম্পাসে ফেরত আসলাম।

এরপর পর দেখতে দেখতে কেটে গেল ২০০১, কেটে গেল ২০০২। অনেক উল্লেখযোগ্য ঘটনা, সেমিস্টার ব্রেকে এক মসজিদ থেকে আরেক মসজিদে জামাত বদ্ধভাবে ছুটে চলা, যা কিনা নিজের চিন্তা চেতনা, বেশ ভুষা, চেহারা, লাইফ স্টাইলে আনল অনেক পরিবর্তন। ২০০৩ এর ২১শে জানুয়ারী দেশে ফিরে আসলাম। মাত্র ২৩ বছরে গ্রাজুয়েশন শেষে সনামধন্য মোবাইল কোম্পানী একটেল (বর্তমানে রবি) তে যোগ দিলাম। বিয়েও করলাম ২০০৩ এর শেষের দিকে। ২০০৪ এর নভেম্বরে আমার বড় ছেলে আনাস ইবনে আমিন বেগের জন্ম।

২০০৭ সালের ঘটনা। আরিচার পাটুরিয়া ফেরীঘাট। আমার এলিয়ন কালো রং এর গাড়িটি ফেরীতে ওঠার পর আমি, আমার স্ত্রী এবং আমার ছেলে ফেরীর ছাদের গিয়ে হাজির। দেখি সেখানে বেশ কিছু মেয়ে আধুনিক পোশাকে দাঁড়ানো। আর তাদের কিছু দূরেই ৭/৮ তরুণ ছেলে অত্যন্ত উচ্ছ্বাসিত এবং বার বার মেয়েদের দিকে তাকিয়ে উচ্চহাসিতে ব্যস্ত। আমি, আমার স্ত্রী এবং আমার ছেলে ফেরীর ছাদের এক কোনায় গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার মুখে এক মুঠ কালো সুন্নতী দাড়ি, মাথায় সাদা টুপির সাথে কালো পাগড়ী, পরনে সাদা পাঞ্জাবী ও পায়াজামা। পায়জামা টাকনুর উপরে। আমার স্ত্রীর পরনে কালো বোরকা পড়া, শুধু চোখ বের করা। হাতে ও পায়ে কালো মোজা পড়া। আনাস আমার কোলে। আমার স্ত্রী আমাকে নিচু স্বরে বলল, “দেখ, ঐ ছেলেদের মধ্যে একজন আমাদের দিকে কেমন অবাকভাবে তাকিয়ে আছে...”।

আমি মুচকি হেসে বললাম, নিজেদের জন্য এবং ওদের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া কর, বল,

“যাবতীয় প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর যিনি তোমার, আমার, ওদেরসহ সকল সৃষ্টি জগতের পালনকর্তা।আমরা একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত করি এবং শুধুমাত্র আল্লাহরই সাহায্য প্রার্থনা করি।
হে আল্লাহ, আমাদেরকে সরল পথ দেখাও, সেই সমস্ত লোকের পথ, যাদেরকে তুমি হেদায়েত দান করেছ। তাদের পথ নয়, যাদের প্রতি তোমার গজব নাযিল হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে”।

1 comment:

  1. চোখের পানি বাধ মানল না...... আলহুমদুলিল্লাহ, আপনি আসলেই ভাগ্যবান, আল্লাহ আপনাকে হেদায়েত করেছেন। আমাদের জন্য ও একটু দোয়া কইরেন ভাই।

    ReplyDelete