মুসলিম জাহানের বিভিন্ন অঞ্চলের দায়িত্বশীলদের প্রতি হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রা.-এর একটি ফরমান ছিল নিম্নরূপ :
"তোমাদের সব বিষয়ের মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘সালাত’। যে তা রক্ষা করেছে অথবা বলেছেন, যে এ ব্যাপারে যত্নবান হয়েছে সে তার দ্বীনকে রক্ষা করেছে। আর যে তা ধ্বংস করেছে সে তো অন্যান্য ব্যাপারে হবে আরো বিধ্বংসী।"
(মুয়াত্তা মালেক, হাদীস ৬; সুনানে কুবরা, বায়হাকী, হাদীস ২০৯৬)
আল্লাহর
রাসূলের দ্বিতীয় খলীফার এ বাণী ও ফরমান এক অমোঘ বাস্তবতার তরজুমান।
আল্লাহর ভয়ই হচ্ছে ঐ মহা নিয়ন্ত্রক শক্তি যা মানুষের ভিতর-বাহির
গোপন-প্রকাশ্য সকল অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে। যে শক্তি দুর্বলকেও নিয়ন্ত্রণ
করে, শক্তিমানকেও নিয়ন্ত্রণ করে, ক্ষমতাহীনকেও নিয়ন্ত্রণ করে, ক্ষমতাসীনকেও
নিয়ন্ত্রণ করে। আল্লাহর ভয় না থাকলে শত ব্যবস্থার মাঝেও অন্যায়-অনাচার
চলতে থাকে এবং অন্যায়-নিয়ন্ত্রণের ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব যাদের
তারাই অন্যায়-অবিচারে জড়িয়ে পড়ে; বরং আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। আর তখনই রক্ষক পরিণত হয় ভক্ষকে আর ব্যবস্থার বজ্র আঁটুনী পর্যবসিত হয় ফস্কা গেরোতে। সত্য যে, পার্থিব জীবনের স্থিতি ও ভারসাম্যের জন্যও তাকওয়া ও আল্লাহ-ভীরুতার কোনো বিকল্প নেই।
আল্লাহভীরু
মানুষের মনেই প্রশ্ন জাগে ন্যায়-অন্যায় এবং করণীয়-বর্জনীয়ের। একারণেই
যে কুরআন সর্বমানবের পথ-প্রদর্শনের জন্য অবতীর্ণ তার শুরুতেই আল্লাহ
রাব্বুল আলামীনের ঘোষণাঃ
"এ কুরআন পথপ্রদর্শক আল্লাহ-ভীরুদের জন্য।" (সূরা
বাকারা ২ : ৩)
অর্থাৎ কুরআনের বিধান ও নির্দেশনায় এদের উপকার হয়। তো এই
আসমানী কালাম ও সর্বোত্তম ব্যবস্থার দ্বারাই যখন শুধু তারাই পরিশুদ্ধ হয়
যারা আল্লাহ-ভীরু, তাহলে
অন্য সকল ব্যবস্থার নীতিকথার উপদেশ বাণীতে আল্লাহর ভয় ছাড়া কীভাবে কারো
পরিশুদ্ধি ঘটতে পারে। একারণে ব্যক্তি-সংশোধন ও সমাজ-সংশোধনের গোড়ার কথা
হচ্ছে, মানুষের
মনে আল্লাহর স্মরণ ও আল্লাহর ভয় জাগ্রত করা। এ সেবাই ব্যক্তি ও সমাজের
সবচেয়ে বড় সেবা। এ সেবায় যারা নিয়োজিত তারাই সমাজ ও ব্যক্তির সবচেয়ে
বড় সেবক। এ সত্য যে জাতি উপলব্ধি করে না সে জাতি আপন শত্রু-মিত্র
নির্ভুলভাবে নির্ণয়ে ব্যর্থ হয়। আর যে নেতৃত্ব এ বাস্তবতা সম্পর্কে
উদাসীন হয় বা উদাসীন বনে তার দ্বারা জাতীয় কল্যাণের আশা আত্মপ্রবঞ্চনা
মাত্র।
জাতীয়
উন্নতি-অগ্রগতির জন্য প্রয়োজনীয় জাগতিক শিক্ষা ও কুশলতা অপরিহার্য। আর এ
কারণে জাতির সর্ব প্রকারের যোগ্যতা ও কর্ম-কুশলতার বিকাশ-চেষ্টা অতি
জরুরি। এ অঙ্গনেও সত্যিকারের কর্ম-পরিকল্পনা ও কর্ম-তৎপরতা তাদের মাধ্যমেই
সম্ভব যারা সত্যিকার অর্থেই জাতির ওফাদার সেবক। জাতির প্রতি ওফাদারীর
প্রভাবক চেতনা এবং ব্যক্তিস্বার্থ ও দলীয় স্বার্থের উর্ধ্বে ওঠার
সৎসাহসেরও প্রধান সূত্র ঈমান ও তাকওয়া। এ দুয়ের অনুপস্থিতিতে ঐ বাস্তবতাই
ঘুরে ঘুরে আসে, মুসলিম জাহান এখন যার ভুক্তভোগী।
দ্বিতীয়ত
জাতির সম্মিলিত মেধা ও কুশলতাকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্যও প্রয়োজন
তাকওয়া ও খোদাভীতির। এর অনুপস্থিতিতে সকল যোগ্যতা ও কর্মশক্তি ব্যবহৃত হয়
ভোগ-বিলাস, অন্যায়-অনাচার
ও যুলুম-অবিচারের নিত্য নতুন কৌশল উদ্ভাবনে। ফলে জাতি নিমজ্জিত হয়
আত্মবিস্মৃতির এক সর্বগ্রাসী অন্ধকারে এবং জড়িয়ে পড়ে আত্মঘাতী ও
ভ্রাতৃঘাতী এক অনিঃশেষ চক্রে। কুরআন মাজীদের ঐ অমোঘ সত্যের মর্মান্তিক
উদাহরণ সৃষ্টি হতে থাকে।
কবির ভাষায় :
"ঐ একটি মাত্র সেজদা যাকে তুমি মনে করেছ সুকঠিন। এ-ই তোমাকে দেয় হাজার সিজদা থেকে মুক্তি"।
যে আল্লাহকে সিজদা করে না সে সিজদা করে শয়তানকে; সিজদা করে নিজ খাহিশ ও প্রবৃত্তিকে, সিজদা করে অর্থ ও স্বার্থকে, সিজদা করে প্রচলিত সকল পার্থিব রীতি-নীতিকে, সিজদা করে সকল অন্যায়-অনাচারকে, সর্বোপরি সিজদা করে এবং করতেই থাকে দেশী-বিদেশী অসংখ্য প্রভুকে। যে ব্যক্তি ও জাতি সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে সিজদা করতে ‘অপমান’ বোধ
করে আল্লাহ তাঁর অসংখ্য দাসকে তার প্রভুতে পরিণত করেন। সে তখন ওদেরকেও
সিজদা করতে থাকে। এসকল দাস-প্রভুর অধীনতা ও দাসত্বই হয় তার ললাট-লিপি।
এই অধীনতা-প্রবণ মানবের কীভাবে পরিচয় ঘটবে প্রকৃত স্বাধীনতার সাথে? আর
কীভাবেই বা সে রক্ষা করবে তার ক্ষুদ্র ও বৃহৎ স্বাধীনতা। অতপর এই শ্রেণীই
যদি নিয়োজিত হয় জাতি-গোষ্ঠির হক্ব রক্ষার দায়িত্বে তখন যে ধ্বংসযজ্ঞের
সূচনা হয় তার ধারা প্রবাহিত হতে থাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
আল্লাহর
নবীর খলীফা, অর্ধ বিশ্ব বিস্তৃত মুসলিম জাহানের আমীরুল মুমিনীন সত্যই বলেছেনঃ
"যে সালাত ধ্বংস করে সে তো অপরাপর বিষয়ে হয় আরো বিধ্বংসী।"
আল্লাহ তাআলা আমাদের ক্ষমা করুন এবং আমাদের ক্ষুদ্র-বৃহৎ, নৈতিক জাগতিক, ভ‚খণ্ডগত, আদর্শগত সর্বপ্রকারের স্বাধীনতা রক্ষার তাওফীক দান করুন।
No comments:
Post a Comment