Friday, January 3, 2014

শয়তান জ্বীন এবং রুক্বিয়া : পবিত্র কুরআন এবং হাদীসের আলোকে আলোচনা

 সংকলকঃ জাভেদ কায়সার

'Exorcism' বা 'রুক্বিয়া' নিয়ে লিখতে গেলে প্রথমেই জ্বীন জাতির উপরে মৌলিক ধারণা থাকা প্রয়োজন। আমাদের মাঝে অনেকেই আছেন যাঁরা জ্বীন এর অস্তিত্বে বিশ্বাস করতে রাজী নন। প্রথম পর্বে তাই জ্বীন জাতির মৌলিক তথ্যগুলো নিয়ে শুরু করছি।

আমি মহান আল্লাহর নিকট বিতাড়িত শয়তান হ'তে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
পরম করুণাময় এবং অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।
 
জ্বীন: সত্য না দৃষ্টিভ্রম
==========

ইসলাম ধর্মে 'অদৃশ্যে' বিশ্বাস স্থাপন করা অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পবিত্র কুরআন শরীফে বলা হয়েছে-
"এ সেই কিতাব যাতে কোনই সন্দেহ নেই। পথ প্রদর্শনকারী পরহেযগারদের জন্য। যারা অদেখা বিষয়ের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং নামায প্রতিষ্ঠা করে। আর আমি তাদেরকে যে রুযী দান করেছি তা থেকে ব্যয় করে." সুরা বাক্বারা (২-৩)

বুঝতেই পারছেন- অদেখা বিষয় বা অদৃশ্যে বিশ্বাস করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরজ বা বাধ্যতামূলক। জ্বীন এই অদৃশ্য বিষয়গুলোর মধ্যে একটি। পবিত্র কুরআনে বেশ কয়েকবার জ্বীনদেরকে মানুষদের সাথে সম্বোধন করা হয়েছে। রাসুলে করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কাছে জ্বীনদের আগমন নিয়ে 'সুরা জ্বীন' নামে একটি সম্পূর্ণ সুরা অবতরণ করা হয়েছে।

জ্বীনদের অস্তিত্ব নিয়ে যাঁরা সন্দিহান, তাঁদের জন্য আমি পবিত্র কুরআন শরীফের কয়েকটি আয়াত নিচে উল্লেখ করছি-

"যখন আমি একদল জ্বীনকে আপনার প্রতি আকৃষ্ট করেছিলাম, তারা কোরআন পাঠ শুনছিল,। তারা যখন কোরআন পাঠের জায়গায় উপস্থিত হল, তখন পরস্পর বলল, চুপ থাক। অতঃপর যখন পাঠ সমাপ্ত হল, তখন তারা তাদের সম্প্রদায়ের কাছে (জ্বীন সম্প্রদায়) সতর্ককারীরূপে ফিরে গেল।" (সুরা আল-আহক্বাফ, ২৯)

"হে জ্বীন ও মানব সম্প্রদায়, তোমাদের কাছে কি তোমাদের মধ্য থেকে পয়গম্বরগণ আগমন করেনি? যাঁরা তোমাদেরকে আমার বিধানাবলী বর্ণনা করতেন এবং তোমাদেরকে আজকের এ দিনের সাক্ষাতের ভীতি প্রদর্শন করতেন? তারা বলবেঃ আমরা স্বীয় গোনাহ স্বীকার করে নিলাম। পার্থিব জীবন তাদেরকে প্রতারিত করেছে। তারা নিজেদের বিরুদ্ধে স্বীকার করে নিয়েছে যে, তারা কাফের ছিল।" (সুরা আল-আনআ'ম, ১৩০)

“আমি জ্বীন ও মানুষকে কেবলমাত্র আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি” (সুরা আয্ যারিয়াত, ৫৬)

"হে জ্বীন ও মানবকূল, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের প্রান্ত অতিক্রম করা যদি তোমাদের সাধ্যে কুলায়, তবে অতিক্রম কর। কিন্তু ছাড়পত্র ব্যতীত তোমরা তা অতিক্রম করতে পারবে না।" (সুরা আর-রহমান, ৩৩)

"বলুনঃ আমার প্রতি ওহী নাযিল করা হয়েছে যে, জ্বীনদের একটি দল কোরআন শ্রবণ করেছে, অতঃপর তারা বলেছেঃ আমরা বিস্ময়কর কোরআন শ্রবণ করেছি।" (সুরা জ্বীন, ১)

"আর এই যে মানুষের মধ্যের কিছু লোক জ্বীন জাতির কিছু লোকের আশ্রয় নিত, ফলে ওরা তাদের পাপাচার বাড়িয়ে দিত।" (সুরা জ্বীন, ৬)

জ্বীনের অস্তিত্ব পবিত্র কুরআন শরীফ ও হাদীস দ্বারা অকাট্যভাবে প্রমাণিত। অসংখ্য সহীহ হাদিস রয়েছে যেগুলোতে জ্বীন জাতিদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আমি পবিত্র কুরআন শরীফের রেফারেন্স দিয়েই শেষ করছি, হাদীসগুলোর রেফারেন্স দেয়ার প্রয়োজন মনে করছি না।

জ্বীন: কিসের তৈরী?
=========

পবিত্র কুরআন এবং হাদীসের মাধ্যমে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় যে, জ্বীন জাতি আগুনের তৈরী।

"আর তিনি জ্বীনকে সৃষ্টি করেছেন আগুনের শিখা দিয়ে।" (সুরা আর-রহমান, ১৫)

"আর আমি এর আগে জ্বীন সৃষ্টি করেছি প্রখর আগুন দিয়ে। (সুতা আল-হিজর, ২৭)

হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সাঃ) বলেছেন- "ফেরেশতারা আলোর তৈরী, জ্বীনরা আগুনের স্ফুলিংগ থেকে তৈরী এবং আদমকে যেভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে তার বর্ণনা (মাটি থেকে) পবিত্র কুরআনে রয়েছে।" (মুসলিম শরীফ ১৮/১২৩ - তাফসীর আল নববী)

জ্বীনের প্রকার
======

হযরত জালাবা আল খাসানি থেকে বর্ণিত, রাসুল (সাঃ) বলেছেন- "তিন ধরনের জ্বীন আছে. এক প্রকারের জ্বীন পাখার মাধ্যমে বাতাসে ওড়ে, এক প্রকারের জ্বীন সাপ এবং মাকড়শার আকারে থাকে, শেষ প্রকারের জ্বীনরা সাধারনভাবে থাকে এবং চলাচল করে।" (আল তাবারানী, আল হাকিম এবং বায়হাক্বী থেকে বর্ণিত)

জ্বীনদের বাসস্থান
========

মানুষের পরিত্যক্ত স্থানগুলোতে জ্বীনরা থাকতে পছন্দ করে। তাদের অধিকাংশই লোকালয় থেকে দুরে নিরব কোন এলাকায় থাকে। তবে কিছু জ্বীন মানুষদের সাথে লোকালয়ে থাকে।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত দীর্ঘ সহীহ হাদিস থেকে জানা যায়, জ্বীনরা নোংরা ও গন্ধময় জায়গায় থাকতে পছন্দ করে যেখানে মানুষরা ময়লা এবং খাবারের উচ্ছিষ্ট অংশ ফেলে রাখে। মানুষের খাবারের উচ্ছিষ্ট জ্বীনদের খাবার। আমাদের ফেলে দেয়া মাংসের হাড়গুলো আল্লাহর কৃপায় মাংসসহ খাবার হয়ে যায় জ্বীনদের জন্য। রাসুল (সাঃ) একারণেই রাস্তার পাশে পড়ে থাকা কোন হাড়ের ওপর প্রস্রাব করা কিংবা মাটি মিশ্রিত হাড়কে ঢিলা হিসেবে ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন।

টয়লেট এবং প্রস্রাব করার জায়গাগুলোতেও জ্বীনদের অবাধ বিচরণ থাকে। হযরত জায়েদ বিন আরকাম (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সাঃ) বলেছেন- "এই জায়গাগুলোতে (টয়লেট এবং প্রস্রাব করার জায়গা) জ্বীন এবং শয়তানরা অবাধে বিচরণ করে। তোমাদের মধ্যে যেই এই স্থানগুলোতে যাবে, সে যেন বলে- 'আমি আল্লাহর কাছে পুরুষ এবং মহিলা শয়তানের থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি'।" (আহমেদ ইবনে হাম্বল, 'পবিত্রতা' খন্ড, ৪/৩৬৯)

পুরুষ এবং মহিলা জ্বীন
==========

উপরের হাদিস থেকেই স্পষ্ট বুঝতে পারা যায় যে জ্বীনদের মধ্যে পুরুষ এবং স্ত্রী জাতি রয়েছে। আয়াতুল কুরসী (সুরা বাক্বারা, ২৫৫) এর ফজিলতের বিষয়ে হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত দীর্ঘ একটি হাদিসের শেষ অংশে উল্লেখ করা হয়েছে- "যে এই আয়াত পড়বে, আল্লাহ পাক তার জন্য একজন প্রহরী নিযুক্ত করে দিবেন এবং কোন পুরুষ এবং নারী জ্বীন-শয়তান তার কাছে আসতে পারবে না." (বুখারী এবং মুসলিম)

ইবলিশ শয়তান এবং জ্বীনের সম্পর্ক
================

পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট উল্লখ করা হয়েছে যে ইবলিশ শয়তান জ্বীনদের একজন।

"যখন আমি ফেরেশতাদেরকে বললামঃ আদমকে সেজদা কর, তখন সবাই সেজদা করল ইবলিশ ব্যতীত। সে ছিল জিনদের একজন। সে তার পালনকর্তার আদেশ অমান্য করল। অতএব তোমরা কি আমার পরিবর্তে তাকে এবং তার বংশধরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করছ? অথচ তারা তোমাদের শত্রু। এটা জালেমদের জন্যে খুবই নিকৃষ্ট বদল।" (সুরা আল-কাহফ, ৫০)

জ্বীনদের ধর্ম
======

আমাদের মতো জ্বীনদের মধ্যেও ভিন্ন ধর্মাবলম্বী রয়েছে। তাঁদের কেউ মুসলমান, কেউ খ্রিষ্টান, কেউ হিন্দু, কেউ বৌদ্ধ। নিচের আয়াতটি নিশ্চিত করে যে আমাদের মতো জ্বীনদেরও ঈমানী বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তাদেরও কিয়ামতের পরে আল্লাহ পাকের কাছে আমাদের মতো বিচারের জন্য দাঁড়াতে হবে।

"হে জ্বীন ও মানব সম্প্রদায়, তোমাদের কাছে কি তোমাদের মধ্য থেকে পয়গম্বরগণ আগমন করেনি? যাঁরা তোমাদেরকে আমার বিধানাবলী বর্ণনা করতেন এবং তোমাদেরকে আজকের এ দিনের সাক্ষাতের ভীতি প্রদর্শন করতেন? তারা বলবেঃ আমরা স্বীয় গোনাহ স্বীকার করে নিলাম। পার্থিব জীবন তাদেরকে প্রতারিত করেছে। তারা নিজেদের বিরুদ্ধে স্বীকার করে নিয়েছে যে, তারা কাফের ছিল।" (সুরা আল-আনআ'ম, ১৩০)

জ্বীন জাতির খাবার
=========

মানুষের মতো জ্বীন জাতিও খাবার গ্রহণ করে। মানুষের উচ্ছিষ্ট খাবার জ্বীনদের জন্য আল্লাহর রহমতে নতুন খাবার হয়ে যায়।

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, রাসুল (সাঃ) বলেছেন- "হাড় এবং গোবর জ্বীনদের খাবার। নসীবাঈন শহরের জ্বীনদের একটি দল আমার সাথে দেখা করতে আসে। কত বিনয়ী ছিল তাঁরা। তাঁরা আমার কাছে মানুষের খাবারের উচ্ছিষ্ট সম্পর্কে জানতে চায়। আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যে তাঁরা এমন কোন হাড় কিংবা গোবর অতিক্রম করবে না যা তাঁদের জন্য খাবার না হয়ে যাবে।" (বুখারী, ৩৫৭১)

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, রাসুল (সাঃ) বলেছেন- "জ্বীনদের একজন আমাকে একদিন ডাকলে আমি তাঁর সাথে যাই। সেখানে আরো জ্বীন ছিল এবং আমি তাদের জন্য পবিত্র কুরআন পাঠ করি। তারা তাদের খাবারের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে আমি বলি- আল্লাহর নাম পড়ে খাওয়া হয়েছে এমন যে কোন হাড় তোমাদের সামনে এলে তা মাংসে পরিনত হয়ে যাবে। একইভাবে গোবর তোমাদের পশুদের খাবার হয়ে যাবে। তাই, ভারমুক্ত (টয়লেট করার পরে) হওয়ার পরে তোমাদের কেউ যাতে এই বস্তুগুলোকে (শুকনো হাড়, গোবর) দিয়ে নিজেকে পরিষ্কার না করে। কারণ ইহুলো তোমাদের ভাইদের খাবার। (মুসলিম, ৪৫০)

জ্বীনদের চলাচলের সময়
===========

হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, রাসুল (সাঃ) বলেছেন- "যখন রাত নামে (সন্ধ্যার শুরুতে) তোমাদের সন্তানদের ঘরের বাইরে যেতে বারণ কর। কারণ শয়তান এই সময়ে বের হয়। এক ঘন্টা পার হলে সন্তানদের যেতে দিও এবং আল্লাহর নাম নিয়ে ঘরের দরজাগুলো বন্ধ কর। কারণ শয়তান বন্ধ দরজা খুলতে পারে না। তারপর আল্লাহর নাম নিয়ে পানির পাত্রের মুখ বন্ধ কর। এরপরে আল্লাহর নাম নিয়ে খাবারের পাত্রগুলো ঢেকে রাখো। যদি ঢেকে রাখার কিছু না পাওয়া যায়, তবে অন্তত অন্য কিছু উপরে দিয়ে রাখো (কাঠ/বই ইত্যাদি)। এবং রাতে শোবার সময়ে কুপি বাতি নিভিয়ে শুতে যেও।" (বুখারী, ১০/৮৮. মুসলিম ১৩/১৮৫)

কিছু প্রাণী জ্বীনদের দেখতে পায়
===============

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, রাসুল (সাঃ) বলেছেন- "যখন তোমরা গাধার চিত্কার শুনতে পাও, তখন আল্লাহর কাছে শয়তানের থেকে আশ্রয় প্রার্থনা কর. কারণ শয়তানকে দেখতে পাবার কারণেই তারা চিত্কার করে।" (বুখারী, ৬/৩৫০. মুসলিম ১৭/৪৭)

জ্বীনদের চেয়ে আল্লাহর কাছে মানুষ বেশি মর্যাদাপূর্ণ
=======================

জ্বীনদের থেকে আল্লাহর দৃষ্টিতে মানুষদের মর্যদা বেশি। পবিত্র কুরআন শরীফে বলা হয়েছে-

"নিশ্চয় আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, আমি তাদেরকে স্থলে ও জলে চলাচলের বাহন দান করেছি; তাদেরকে উত্তম জীবনোপকরণ প্রদান করেছি এবং তাদেরকে অনেক সৃষ্ট বস্তুর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।" (সুরা বনী ইসরাইল, ৭০)

তারপরেও অজ্ঞতার কারণে অনেক মানুষ বিভিন্ন বিষয়ে জ্বীনদের সহায়তা চায়। এই রকম অযৌক্তিক কাজ শিরকের অন্তর্ভুক্ত। জ্বীন তখন মানুষকে নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসতে চায়। কারণ শ্রেষ্ঠত্ব থাকা স্বত্তেও মানব সন্তান তার কাছে সাহায্য চেয়ে শিরক করেছে!

পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে-

"আর এই যে মানুষের মধ্যের কিছু লোক জ্বীন জাতির কিছু লোকের আশ্রয় নিত, ফলে ওরা তাদের পাপাচার বাড়িয়ে দিত।" (সুরা জ্বীন, ৬)

জ্বীন মানুষ কিংবা প্রাণীর আকার ধারণ করতে পারে
========================

মহান আল্লাহ পাকের দেয়া শক্তি ব্যবহার করে শয়তান জ্বীন মানুষ কিংবা প্রাণীর আকার বা রূপ ধারণ করতে পারে। সহীহ হাদীসের মাধ্যমে এই সত্য প্রতিষ্ঠিত।

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত দীর্ঘ একটি হাদীসে এক দুষ্ট লোকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে যে প্রতি রাতে যাকাতের মাল চুরি করতে আসতো। আবু হুরায়রা (রাঃ) প্রতি রাতেই তাকে ধরে ফেলতেন। কিন্তু লোকটি বিভিন্ন অনুরোধ করে মাফ নিয়ে চলে যেত এবং পরের রাতে আবার চুরি করতে আসতো। পরপর তিন রাতে সেই মানুষটিকে ধরার পরে রাসুল (সাঃ) কে ঘটনা অবহিত করলে তিনি আবু হুরায়রা (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করেন, "ওহে আবু হুরায়রা, তুমি কি জানো তুমি এই তিন রাতে কার সাথে কথা বলেছ? ওটা শয়তান ছিল।" (বুখারী, ৩২৭৫)

বদরের যুদ্ধের সময় ইবলিশ শয়তান মক্কার কুরাইশদের কাছে বনু কিনানাহর সর্দার সুরাক্বা ইবনে যুশাম এর আকার ধরে গিয়ে তাদেরকে রাসুল (সাঃ) এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্ররোচনা দিয়েছিল। (ইবনে কাসীর, আল বিদায়া ওয়াল নিহায়া, ৫/৬২)

হযরত আবু সাইদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলে পাক (সাঃ) বলেছেন- "মদিনার কিছু সংখ্যক জ্বীন মুসলমান হয়েছে। এদেরকে (প্রাণী হিসেবে) যদি কেউ দেখো, তাহলে তিনবার সাবধান করবে। তারপরেও আবার এলে সেই প্রাণীকে হত্যা করবে।" (মুসলিম, ২২৩৬)

জ্বলন্ত উল্কাপিন্ড শয়তান জ্বীনকে ধাওয়া করে
=================

শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর নবুওয়তের আগ পর্যন্ত জ্বীন জাতি আকাশে প্রান্ত সীমা পর্যন্ত গিয়ে ঘাপটি মেরে সংবাদ সংগ্রহের জন্য লুকিয়ে থাকত। আল্লাহ পাক যখন কোন আদেশ করতেন ফেরেশতাদের, তখন ফেরেশতারা সেই আদেশ মুখে মুখে ছড়িয়ে দিত। শয়তান জ্বীন তখন টুকরো টুকরো কিছু খবর চুরি করে পৃথিবীতে এসে সেগুলোর সাথে বিভিন্ন মিথ্যা মিশিয়ে ভাগ্য গণনাকারীদের কাছে বলত, যার কিছু কিছু পরবর্তীতে সত্য হিসেবে প্রকাশ পেত।

রাসুলের নবুওয়তের পরে আল্লাহ পাক উর্ধ্বাকাশ এবং নিচের আকাশের মাঝে একটি পর্দা দিয়ে দিলেন। ফলে শয়তান জ্বীনরা আর কোন আদেশ শুনতে পেত না। বরং চুরি করে খবর শুনতে নিলেই জ্বলন্ত উল্কাপিন্ড তাদের পিছু নিত।

হঠাত করেই এই রকম পরিবর্তনে অবাক হয়ে শয়তান তার অধীনস্থ সকল জ্বীনদের পৃথিবীর আনাচে-কোনাচে পাঠিয়ে দিল মূল খবর বের করার জন্য-- কি এমন ঘটনা ঘটেছে যার কারণে উর্ধ্বাকাশ থেকে কোন খবর আনা যাচ্ছে না? খবরের সন্ধানে জ্বীনদের একদল যখন নাখালা নামের জায়গা দিয়ে যাচ্ছিল, রাসুল (সাঃ) তখন সেই পথে 'উকাজ' নামের বাজারে ইসলামের দাওয়াতের জন্য যাচ্ছিলেন। জ্বীনদের দল যখন সেখানে পৌঁছল, রাসুল (সাঃ) তখন সাহাবীদের নিয়ে ফজরের নামাজ পড়ছিলেন। রাসুল (সাঃ) এর মুখে কুরআনের তেলাওয়াত শুনেই জ্বীনদের সেই দল বুঝতে পারল কি কারণে তাদেরকে উর্ধ্বাকাশে যেতে বাধা দেয়া হচ্ছিল। তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং নিজ সম্প্রদায়ের কাছে সংবাদ নিয়ে ফেরত যায়।

"বলুনঃ আমার প্রতি ওহী নাযিল করা হয়েছে যে, জিনদের একটি দল কোরআন শ্রবণ করেছে, অতঃপর তারা বলেছেঃ আমরা বিস্ময়কর কোরআন শ্রবণ করেছি; যা সৎপথ প্রদর্শন করে। ফলে আমরা তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমরা কখনও আমাদের পালনকর্তার সাথে কাউকে শরীক করব না। এবং আরও বিশ্বাস করি যে, আমাদের পালনকর্তার মহান মর্যাদা সবার উর্ধ্বে। তিনি কোন পত্নী গ্রহণ করেননি এবং তাঁর কোন সন্তান নেই। আমাদের মধ্যে নির্বোধেরা আল্লাহ তা’আলা সম্পর্কে বাড়াবাড়ির কথাবার্তা বলত।" (সুরা জ্বীন ১-৪)

"আমরা আকাশ পর্যবেক্ষণ করছি, অতঃপর দেখতে পেয়েছি যে, কঠোর প্রহরী ও উল্কাপিন্ড দ্বারা আকাশ পরিপূর্ণ। আমরা আকাশের বিভিন্ন ঘাঁটিতে সংবাদ শ্রবণার্থে বসতাম। এখন কেউ সংবাদ শুনতে চাইলে সে জলন্ত উল্কাপিন্ড ওঁৎ পেতে থাকতে দেখে।" (সুরা জ্বীন, ৮-৯)

"নিশ্চয় আমি নিকটবর্তী আকাশকে তারকারাজির দ্বারা সুশোভিত করেছি। এবং তাকে সংরক্ষিত করেছি প্রত্যেক অবাধ্য শয়তান থেকে। ওরা উর্ধ্ব জগতের কোন কিছু শ্রবণ করতে পারে না এবং চার দিক থেকে তাদের প্রতি উল্কা নিক্ষেপ করা হয়। ওদেরকে বিতাড়নের উদ্দেশে। ওদের জন্যে রয়েছে বিরামহীন শাস্তি। তবে কেউ ছোঁ মেরে কিছু শুনে ফেললে জ্বলন্ত উল্কাপিন্ড তার পশ্চাদ্ধাবন করে।" (সুরা আস-সাফফাত, ৬-১০)

জ্বীন কি মানুষের ওপর ভর করতে পারে?
==================

জ্বীনের মানুষের ওপর ভর করা কিংবা মানুষের যাদুগ্রস্থ হওয়াকে সাধারনভাবে আরবীতে 'সাহর' বলে। এটি এমন একটি অবস্থা যখন মানুষের নিজের ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায় এবং সাময়িক স্মৃতি বিভ্রম ঘটে। পবিত্র কুরআন এবং হাদীসের আলোকে 'সাহর' একটি নিশ্চিত বিষয়।

"যারা সুদ খায়, তারা কিয়ামতে দন্ডায়মান হবে, যেভাবে দন্ডায়মান হয় ঐ ব্যক্তি, যাকে শয়তান আসর করে মোহাবিষ্ট করে দেয়।" (সুরা বাক্বারা, ২৭৫)

শয়তানের আসরে মানুষ মোহাবিষ্ট হয়ে পড়ে - এই বিষয়টি নিশ্চিত। ইমাম কুরতুবী, তাবারী, ইবনে-কাসীর সহ অধিকাংশ তাফসীরবিদ এই আয়াতকে জ্বীনের মানুষের ওপর ভর করার সুনির্দিষ্ট প্রমান হিসেবে উল্লেখ করেছেন। (তাফসীর আল কুরতুবী ৩/৩৫৫, তাফসীর আল তাবারী ৩/১০১, তাফসীর ইবনে কাসীর ১/৩২৬)

সহীহ হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে-

রাসুল (সাঃ) বলেছেন- "শয়তান আদম সন্তানের শরীরে প্রবাহিত হয়, যেমন রক্ত শরীরে প্রবাহিত।" (বুখারী, ৩৩/২৫১। মুসলিম, ২১৭৫)

ইমাম আহমদের ছেলে আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত, "আমি আমার বাবা (ইমাম আহমাদ) কে বললাম- কিছু মানুষ মানুষের শরীরে জ্বীনের ভর করাকে বিশ্বাস করে না। তিনি বলেন- ও আমার সন্তান, তারা মিথ্যা বলছে। আসর করা অবস্থায় অসুস্থ লোকের মুখ দিয়ে জ্বীন কথাও বলতে পারে।" (মাজমু ফতোয়া- ইবনে তাইমিয়াহ ১৯/১২)

ইমাম আহমদ এবং ইমাম বায়হাকী কর্তৃক লিপিবদ্ধ সহীহ হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে, রাসুল (সাঃ) একবার একটি অসুস্থ বালকের সাক্ষাত পেয়েছিলেন যার ওপর জ্বীনের ভর ছিল। রাসুল পাক (সাঃ) ছেলেটির দিকে ফিরে জোরে বলেন- "ও আল্লাহর শত্রু, বের হয়ে আসো। ও আল্লাহর শত্রু, বের হয়ে আসো। ছেলেটি দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে।" (ইবনে মাজাহ, ৩৫৪৮। আহমদ ৪/১৭১, ১৭২)

এছাড়াও বিভিন্ন সাহাবীদের থেকে অসংখ্য সহীহ হাদিস বর্ণনা করা হয়েছে এই প্রসঙ্গে যেখানে রাসুলে পাক (সাঃ) সাহরগ্রস্থ রোগীর ওপরে দোআ করে সাহর মুক্ত করেছেন। সাহাবীদের মধ্যে হযরত ইয়ালা ইবনে মুররাহ (রাঃ), জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ), আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:),আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ), আবু আল ইয়ুসর (রাঃ), সাফিয়া বিনতে হুয়াই (রাঃ), উবাই ইবনে কা'ব (রাঃ), উসমান বিন আল'আস (রাঃ) উল্লেখযোগ্য। সময়ের অভাবে সবগুলো ঘটনা উল্লেখ করা সম্ভব হলো না।

জ্বীন কি মানুষের ওপর ভর করার সম্ভাব্য কারণ:
===================

ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ বিভিন্ন সহীহ হাদিস, নিজ চোখে দেখা ঘটনা এবং রুক্বিয়ার ভিত্তিতে প্রাপ্ত তথ্য থেকে মানুষের ওপর জ্বীনের ভর করার সম্ভাব্য কারণগুলো উল্লেখ করেছেন। কারণগুলোর স্বপক্ষের হাদীসগুলো গত দুই পর্বেই আলোচনা করা হয়েছে। নিচে কারণগুলো উল্লেখ করছি-

১.পুরুষ কিংবা মহিলা জ্বীনের বিপরীত লিঙ্গের মানুষের প্রতি স্বভাবজাত মুগ্ধতা।

২.জ্ঞানত কিংবা নিজের অজান্তে মানুষের মাধ্যমে কোন জ্বীনের ক্ষতি সাধিত হলে। (গরম পানি ফেলা, প্রস্রাব করা, ইটের টুকরা নিক্ষেপ করা, জ্বীনদের খাবার হাড়/গোবরকে নষ্ট করা, প্রাণীর আকার নেয়া অবস্থায় মারা ইত্যাদি)

৩.শুধুমাত্র অনিষ্টের উদ্দেশ্যে ভর করা। সাধারণত মানুষের তিনটি অবস্থায় শয়তান জ্বীন এই সুযোগ গ্রহণ করে: তীব্র রাগের সময়ে, তীব্র ভয়ের সময়ে এবং মন্দ কোন কিছুর জন্য তীব্র আকাংখার সময়ে। একটু লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবেন, এই তিনটি পর্যায়ে মানুষের নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ খুব কম থাকে এবং আল্লাহর বিশ্বাসের পথ থেকে দুরে থাকে।

৪.যাদু-টোনার /কু-নজরের কারণে। (যাদু এবং কু-নজরের বিষয়টি ইসলামে অকাট্যভাবে প্রমানিত। রাসুল (সাঃ) এর চুল নিয়ে জনৈক ইহুদী কর্তৃক যাদু করা এবং 'সুরা নাস' এবং 'সুরা ফালাক' এর অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট এবং সহীহ বুখারীর অসংখ্য হাদীস (সহীহ বুখারী ৭১/৬৩৪, ৭৮৪, ৮২৭। ৭/৬৫৮। ৭৫/৪০০। ৬৬/৩৭৮। ৫৪/৪৯০। ৫৩/৪০০) এর প্রমান। কিছু যৌক্তিক কারণে এই বিষয়টি নিয়ে কোন কিছু বিস্তারিত লেখা থেকে নিজেকে বিরত রাখছি। বিস্তারিত জানতে চাইলে নিজে তাফসীর পড়তে পারেন কিংবা কোন মুফতির সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। আমি শয়তান জ্বীনের হাত থেকে রক্ষা পাবার উপায় নিয়ে যখন লিখব, একই সাথে যাদু এবং কু-নজরের হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার উপায় নিয়েও লিখব ইনশাআল্লাহ।)

মানুষের ওপর জ্বীন ভর করার সম্ভাব্য লক্ষণ সমূহ:
==================

সবার প্রথমে একটি বিষয় নিশ্চিত করতে চাই. পবিত্র কুরআন এবং হাদীসের আলোকে জ্বীন আসর করার লক্ষণ সমূহের বিষয়ে "মোহাবিষ্ট", "উদভ্রান্ত" ইত্যাদি ছাড়া বিস্তারিত কিছু বলা হয় নি। ইবনে তাইমিয়াহ, ইবনে কাসীর, জালালুদ্দিন সুয়ুতি, আব্দুল খালিক আল-আত্তার প্রমুখ প্রখ্যাত ইসলামী ব্যক্তিত্বের লিখিত বইয়ের ভিত্তিতে প্রসিদ্ধ মিশরীয় আলিম ওয়াহিদ আব্দুল সালাম নিচের লক্ষনগুলো বর্ণনা করেছেন। মদিনা ইউনিভার্সিটির সম্মানিত শিক্ষক, বিশিষ্ট ফকীহ এবং আলিম আবুবকর জাবির আল-জাজাইরি (শেখ আব্দুল্লাহ বিন বাজ এর স্নেহধন্য) এই লক্ষনগুলো নিশ্চিত করেছেন।

রুক্বিয়া বিষয়ে আমার দীর্ঘ পড়াশুনায় যতগুলো বইয়ে সাহর এর "লক্ষণ" এর কথা লেখা দেখেছি। প্রায় সব জায়গায় একটি বিষয় প্রথমে নিশ্চিত করা হয়েছে। কারো ওপরে শয়তান জ্বীনের আসরের কারণে লক্ষনগুলো দেখা দিতে পারে। কিন্তু এই লক্ষণ থাকা মানেই কেউ শয়তান জ্বীনের দ্বারা আক্রান্ত- এটা ভাবার কোন যৌক্তিকতা নেই। বর্তমানে চিকিত্সা বিজ্ঞান অনেক উন্নত। প্রথমেই একজন ভালো ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত হবে।

রুক্বিয়া "অল্টারনেটিভ মেডিসিন" হিসেবে ব্যবহার করা হয়। চিকিত্সা বিজ্ঞানের কোন বিরোধ নেই এই প্রক্রিয়ার সাথে। উপরন্তু, একজন যোগ্য এবং রুক্বিয়ার বিষয়ে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন আলিম ছাড়া জ্বীনের আসর করার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া এবং রুক্বিয়া শুরু করা "তীব্রভাবে নিরুত্সাহিত" করা হয়েছে।

দুই ধরনের লক্ষণের কথা আলোচনা করা হয়েছে- ঘুমন্ত অবস্থায় লক্ষণ, জাগ্রত অবস্থায় লক্ষণ।

ঘুমন্ত অবস্থায় লক্ষণ:
=======
১.উদ্বেগ জনিত অনিদ্রা। ২.দুঃস্বপ্ন। ৩.ক্রমাগত স্বপ্নে ভয়ংকর প্রাণী দেখা। ৪.ঘুমের মধ্যে অতিরিক্ত হাসি, কান্না, চিত্কার, গোঙানি। ৫.নিয়মিত ঘুমের ঘোরে হাঁটা ইত্যাদি

জাগ্রত অবস্থায় লক্ষণ:
=======
১.কোন শারীরিক সমস্যা ছাড়াই তীব্র মাথা ব্যথা। ২.আল্লাহ, রাসুল (সাঃ) এবং ইসলাম ধর্মের নিয়ম-কানুন গুলোর উপরে তীব্র বিতৃষ্ণা। ৩.সবসময় প্রচন্ড অমনোযোগী, অলস এবং মানসিকভাবে বিক্ষিপ্ত থাকা। ৪.কোন শারীরিক সমস্যা ছাড়াই প্রায়ই তীব্র খিঁচুনি। ৫.কোন শারীরিক সমস্যা ছাড়াই শরীরের বিশেষ কোন একটি অঙ্গে তীব্র ব্যথা ইত্যাদি।

মানুষের ওপর জ্বীন ভর করার প্রকার:
=================

তিন ধরনের আসর হতে পারে শয়তান জ্বীনের মাধ্যমে-

১.সামগ্রিক: পুরোপুরি ভর করা. প্রায়ই খিঁচুনি সামগ্রিক ভর নিশ্চিত করে।
২.আংশিক: শরীরের কোন একটি নির্দিষ্ট অঙ্গে ভর করা. যেমন- পা, হাত, জিহ্বা ইত্যাদি।
৩.স্বল্পস্থায়ী: এই ধরনের আসরে রোগী মিনিট দুইয়েকের জন্য অজ্ঞান হয়ে যায় সাধারণত। অনেকটা দুঃস্বপ্ন দেখার মতো অভিজ্ঞতা হয় রোগীর।

রুক্বিয়া সম্পন্ন করার প্রক্রিয়া:
==========

অত্যন্ত যৌক্তিক কিছু কারণে রুক্বিয়া পরিচালনার প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু উল্লেখ করব না। ইবলিশ এবং শয়তান জ্বীন মানুষের আজন্ম শত্রু। এদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে নামলে পাল্টা আক্রমন খুবই স্বাভাবিক। নিজেকে প্রস্তুত না করে এই যুদ্ধে নামা নিছক বোকামী এবং বিপদজনক।

একজন পরিপূর্ণ মুসলিম- যিনি রুক্বিয়া পরিচালনা করার দায়িত্ব নিতে চান, তাঁর নিচের গুনাবলী থাকা অত্যাবশ্যক। নিচের উল্লেখিত গুনাবলী যাচাই করে আমরা নিজেরাই বিবেচনা করতে পারি, আমাদের মধ্যে কে কতটুকু যোগ্য এই কাজের জন্য।

রুক্বিয়া পরিচালনাকারীর আবশ্যক গুনাবলী:
===============

১.তাঁর ঈমানের ভিত অত্যন্ত মজবুত হতে হবে. ঈমানের সকল শাখা-প্রশাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ এবং পূর্ণ দখল থাকতে হবে।

২.ইসলামের একত্ববাদের (তাওহিদ) শক্ত কান্ডারী হতে হবে তাঁকে।

৩."আল্লাহ সুবহানুওয়াতাআ'লার কথা পবিত্র কুরআন শরীফের আয়াত শয়তান জ্বীনদের উপরে ভয়ংকর কার্যকারী"- এই ধ্রুব সত্যে বিশ্বাসী এবং যে কোন পরিস্থিতে এই সত্যের ওপরে পর্বত প্রমান স্থির থাকতে হবে।

৪.ইবলিশ এবং শয়তান জ্বীনদের আচরণ, জীবন যাপন থেকে শুরু করে তাদের কর্মকান্ডের বিষয়ে যতদুর সম্ভব স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে। আমার আগের পর্বগুলোতে আমি গুটিকয়েক হাদীস বর্ণনা করেছি মাত্র। এ সংক্রান্ত অসংখ্য হাদীস এবং নামকরা তাবেঈ'ন, তাবে তাবেঈ'নদের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ বই রয়েছে।

৫.কারো ওপরে ভর করার পরে শয়তান জ্বীনদের ধূর্ত আচরণ এবং ফাঁদ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে।
[এ প্রসঙ্গে ইবনে তাইমিয়াহ (রঃ) এর একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। জ্বীনের আসর করা এক রোগীর ওপরে রুক্বিয়া পরিচালনা করার এক পর্যায়ে শয়তান জ্বীন জানায় যে সে ইবনে তাইমিয়াহ (রঃ) এর সম্মানে রোগীকে ছেড়ে চলে যাবে। ইবনে তাইমিয়াহ সেই মুহুর্তেই পাল্টা জবাব দিয়ে বলেন যে তাঁর সম্মানে চলে যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই জ্বীনের। শুধুমাত্র আল্লাহকে ভয় এবং সম্মান করার কারণে সে রোগীকে ছেড়ে যেতে পারে। ইবনে তাইমিয়াহ এর জন্য এটি ফাঁদ ছিল। তিনি যদি তাঁর সম্মানে জ্বীনের চলে যাওয়াতে রাজী হতেন, তাহলে আল্লাহর উপরে তাঁর অবস্থানের কথাতে (নাউজুবিল্লাহ) প্রকারন্তে সম্মতি জানানো হতো। রুক্বিয়া পরিচালনা করার সময় শয়তান জ্বীন এরকম অসংখ্য উপায়ে পরিচালনাকারীকে ফাঁদে ফেলতে চায়।]

৬.রুক্বিয়া পরিচালনাকারী একজন বিবাহিত মানুষ হলে উত্তম।

৭.ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ যাবতীয় কাজ থেকে তাঁকে অবশ্যই দুরে থাকতে হবে।

৮.শুধুমাত্র রাসুলে করীম (সাঃ) কর্তৃক শিক্ষা দেয়া দোআ এবং পবিত্র কুরআনের আয়াত দিয়ে রুক্বিয়া পরিচালনার অভ্যাস থাকতে হবে। কোন প্রকার বিদআ'ত/কুফরী কর্মকান্ডের অনুসারী হওয়া যাবে না- সেটা যত খারাপ অবস্থাতেই হোক না কেন।

৯.রুক্বিয়ার মাধ্যমে রোগীকে সুস্থ করা ছাড়া তাঁর অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকা যাবে না।

১০.তাঁর মনে দৃঢ় বিশ্বাস থাকতে হবে-- যেহেতু তিনি আল্লাহর প্রতি আনুগত্যশীল, সেহেতু আল্লাহ পাক তাকে শয়তান জ্বিনের ওপরে জয়ী অবশ্যই করবেন ইনশাআল্লাহ।

উপরের আবশ্যক গুনাবলী থেকে স্পষ্ট বুঝতে পারা যায়- সবার পক্ষে রুক্বিয়া পরিচালনা করা সম্ভবপর নয়, উচিতও হবে না।

শয়তান জ্বীনের আসর, যাদু এবং বদ নজর থেকে বেঁচে থাকার উপায়:
==========================

ইবলিশ এবং ইবলিশের অনুগত শয়তান জ্বীন মানুষের আজন্ম শত্রু। তারা সবসময় মানুষদের পেছনে পথভ্রষ্ট করার জন্য কাজ করে। কিন্তু আল্লাহ সুবহানুওয়াতাআ'লা অভয় দিয়েছেন যে যারা আল্লাহর দেখানো পথে চলবে- তাদের ওপর শয়তান কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পারবে না।

পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন বিষয়ে এই সম্পর্কে স্পষ্ট উল্লেখ করা আছে--

"শয়তান তোমাদের শত্রু; অতএব তাকে শত্রু রূপেই গ্রহণ কর। সে তার দলবলকে আহবান করে যেন তারা জাহান্নামী হয়।" (সুরা ফাতির, ৬)

"হে বনী-আদম! আমি কি তোমাদেরকে বলে রাখিনি যে, শয়তানের এবাদত করো না, সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু?" (সুরা ইয়া সীন, ৬০)

"সে (ইবলিশ) বললঃ আমাকে কেয়ামত দিবস পর্যন্ত অবকাশ দিন। আল্লাহ বললেনঃ তোকে সময় দেয়া হল। সে বললঃ আপনি আমাকে যেমন উদভ্রান্ত করেছেন, আমিও অবশ্য তাদের জন্যে আপনার সরল পথে বসে থাকবো। এরপর তাদের কাছে আসব তাদের সামনের দিক থেকে, পেছন দিক থেকে, ডান দিক থেকে এবং বাম দিক থেকে। আপনি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবেন না। আল্লাহ বললেনঃ বের হয়ে যা এখান থেকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়ে। তাদের যে কেউ তোর পথেচলবে, নিশ্চয় আমি তোদের সবার দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করে দিব।" (সুরা আল-আ'রাফ, ১৪-১৮)

"সে (ইবলিশ) বললঃ আমার প্রভু! তুমি যেমনি আমাকে বিপথে যেতে দিয়েছ, আমিও তেমনি নিশ্চয়ই তাদের নিকট চিত্তাকর্ষক করব এই পৃথিবীতে, আর অবশ্যই তাদের একসাথে বিপথগামী করব -- তাদের মধ্যে তোমার খাস বান্দাদের ব্যতীত। তিনি (আল্লাহ) বললেনঃ এটিই হচ্ছে আমার দিকে সহজ-সঠিক পথ। নিঃসন্দেহ আমার দাসদের সন্বন্ধে -- তাদের উপরে তোমার কোনো আধিপত্য নেই, বিপথগামীদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করে তাদের ব্যতীত।" (সুরা আল-হিজর, ৩৮-৪২)

"নিঃসন্দেহ আমার বান্দাদের সন্বন্ধে, -- তাদের উপরে তোমার কোনো প্রভাব নেই। আর কর্ণধাররূপে তোমার প্রভুই যথেষ্ট।" (সুরা বনী ইসরাঈল, ৬৫)

উপরের আয়াতগুলোর মাধ্যমে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে মহান আল্লাহ পাকের দেখানো পথে যাঁরা চলবেন, তাঁদেরকে ইবলিশ এবং তার জ্বীনবাহিনী কোনভাবেই কাবু করতে পারবে না। আলহামদুলিল্লাহ!

সুতরাং শয়তান জ্বীনের আসর, যাদু এবং বদ নজর থেকে বেঁচে থাকার সর্বোত্তম এবং শ্রেষ্ঠ উপায় হলো "সীরাতুল মুস্তাকিম" এর পথে চলা। সোজা কথায়- আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসুলের প্রকৃত আনুগত্য এবং প্রদর্শিত উপায়ে শান্তির ধর্ম ইসলামের বিধানসমূহ মোতাবেক জীবন যাপন করা।

এর বাইরেও সহীহ হাদীসের ভিত্তিতে কিছু কিছু বিষয়ে অবশ্যই সতর্কতা অনুসরণ করা উচিত সবার। এছাড়া পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াত এবং রাসুলে করীম (সাঃ) এর নিজের শেখানো এবং পড়া কিছু দোআও রয়েছে- যেগুলো নিয়মিতভাবে নির্দিষ্ট কিছু সময়ে পড়লে শয়তান জ্বীনের আসর, যাদু এবং বদ নজর থেকে নিজেকে যথাসম্ভব রক্ষা করা যায়।


শয়তান জ্বীনের আসর, যাদু এবং বদ নজর থেকে বেঁচে থাকার উপায়:
==========================

গত পর্বে আমি উল্লেখ করেছিলাম যে শয়তান জ্বীনের আসর, যাদু এবং বদ নজর থেকে বেঁচে থাকার সর্বোত্তম এবং শ্রেষ্ঠ উপায় হলো "সীরাতুল মুস্তাকিম" এর পথে চলা। সোজা কথায়- আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসুলের প্রকৃত আনুগত্য এবং প্রদর্শিত উপায়ে শান্তির ধর্ম ইসলামের বিধানসমূহ মোতাবেক জীবন যাপন করা।

এর বাইরেও সহীহ হাদীসের ভিত্তিতে কিছু কিছু বিষয়ে অবশ্যই সতর্কতা অনুসরণ করা উচিত সবার। হাদীসগুলোর বিষয়ে আগের পর্বগুলোতে বিস্তারিত উল্লেখ করেছি। তাই নিচে বিষয়গুলো পয়েন্ট আকারে উল্লেখ করছি।

১.খাবার খাওয়া, পানি খাওয়া থেকে শুরু করে যে কোন কাজ মহান আল্লাহ সুবহানুওয়াতাআ'লার নাম নিয়ে শুরু করা।
২.উঁচু কোন জায়গা থেকে লাফ দেয়ার আগে মহান আল্লাহ পাকের নাম স্মরণ করা/পড়া।
৩.কোন অন্ধকার রুমে প্রবেশ করার আগে মহান আল্লাহ পাকের নাম স্মরণ করা/পড়া।
৪.কোথাও গরম পানি ফেলা/ঢালার আগে মহান আল্লাহ পাকের নাম স্মরণ করা/পড়া।
৫.কোন কারণ ছাড়া কোন প্রাণীকে আঘাত না করা।
৬.কোন যৌক্তিক কারণ ছাড়াই একাকী রুমে না ঘুমানো। পরিস্থিতির কারণে যদি একাকী রুমে ঘুমাতে হয়- তাহলে ওজু করে মহান আল্লাহ পাকের নাম স্মরণ করে ঘুমাতে যাওয়া।
৭.কোন গর্ত কিংবা গুহায় প্রস্রাব না করা।
৮.বাসা-বাড়ির ভেতরে কোন সাপ দেখলে সাথে সাথে তাকে হত্যা না করা। বরং তাকে মহান আল্লাহর ওয়াস্তে চলে যেতে বলা উচিত। তিনদিনে তিনবার আল্লহর ওয়াস্তে চলে যাবার কথা বলার পরেও চতুর্থ দিন সাপটিকে হত্যা করা যেতে পারে। (তিনদিন কিংবা তিনবার বলার বিষয়ে আগের একটি পর্বে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।)
৯.সূর্যের আলো এবং কোন কিছুর ছায়ার মিলনরেখায় না বসা।
১০. টয়লেটে প্রবেশের আগে রাসুলে করীম (সাঃ) এর শেখানো দোআ পড়ে নেয়া। দোআটি পরে উল্লেখ করছি।
১১.যৌক্তিক কারণ ছাড়া বাথরুমে অতিরিক্ত সময় না কাটানো। গোসলের সময় পুরোপুরি নগ্ন না হয়ে গোসল করা।
১২.কোন কারণ ছাড়া গভীর রাতে একাকী রাস্তা-বন-মরুভূমিতে ঘুরাঘুরি না করা।
১৩.উঁচু কোন জায়গা থেকে কোন কিছু নিচে নিক্ষেপ করার আগে মহান আল্লাহ পাকের নাম স্মরণ করা/পড়া।
১৪.গোবর কিংবা হাড় মেশানো মাটির চাকাকে ঢিলা হিসেবে ব্যবহার না করা।
১৫.হাসি, কান্না, রাগ, ক্ষোভ- কোন কিছুতেই তীব্রভাবে আচরণ করা। সব কিছুতেই মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা উত্তম।
১৬.সব সময়, বিশেষ করে রাগের সময় অশ্লীল কথা থেকে নিজেকে বিরত রাখা।
১৭.ইসলামের বিধান মোতাবেক পর্দা প্রথা মেনে চলা।
১৮.কোন কারণে শয়তান জ্বীনদের আক্রমনের শিকার হচ্ছে

No comments:

Post a Comment