Monday, November 11, 2013

আত্মকথনঃ ৪



২০০১ সালের ফেব্রুয়ারি/মার্চ মাস। বিদেশের মাটিতে তখন ২১ বছর বয়সী শরীরে মুক্তচিন্তা মিশ্রিত বাধাহীন উত্তাল তরঙ্গপ্রবন রক্তের প্রবাহ। ছাত্রজীবন, তাই অন্তরে অফুরন্ত ব্যক্তিস্বাধীনতা আর তথাকথিত আধুনিকতার চেতনা সদা জাগ্রত। কে যেন সর্বদা চোখে এক রঙ্গিন চশমা লাগিয়ে রেখেছে। চারপাশে যা কিছু, সবকিছুকেই নিজের মন মত করে দেখার প্রয়াস। যেন কল্পনার মধ্যেই শতকরা ৮০ ভাগ সফলতা। বর্তমান কালের ‘মেয়ে বন্ধুহীন’ শুকনো জিন্দেগী। অথচ ক্যাম্পাসের দুই তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থীই মেয়ে। আর বিদেশী ছাত্রদের মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত আর পাকিস্তান থেকে আগত আমরা কয়েকজন মিলে তৈরী করে ফেলেছি নিজেদের উপদল। ক্লাস বাদে ক্যাম্পাসের ক্যাফেই হোক আর লাইব্রেরীই হোক একসাথে থাকতেই হবে, দুপুরের এবং রাতের খাবার যতখানি সম্ভব এক সঙ্গে খেতে হবে, যত মনের খবর একসাথে আলোচনা করতে হবে, না করলে পেটের ভাত হজম হবে না --- রাতে ঘুম হবে না। আজ ক্লাসে কোন মেয়ে কি করল, কোন ছেলের সাথে নতুন কোন মেয়েকে দেখা যাচ্ছে, সেই ছেলেকে আর কার সাথে দেখা গেছে আর কত কি! মজার ব্যাপার হল এই জাতীয় আলোচনা অনেক সময়ই বাংলা হিন্দি আর উর্দুতে চলতো যাতে লোকাল ছাত্র বা ছাত্রীরা না বুঝতে পারে। আর সে সময় কাজ করতে আসা আমাদের কয়েক বাংলাদেশী ভাইদের অপকর্মের কারণে আমরা বাংলাদেশীরা বেশ ইমেজ সংকটে ভুগছি।
এই সেমিস্টারে ক্যারেন নামে এক চাইনিজ মেয়ের সাথে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠল ল্যাব ক্লাসে এক গ্রুপে হওয়ায়। যাইহোক, সেমিস্টার ফাইনালের আগ দিয়ে শেষ টিউটোরিয়াল পরীক্ষা। পরীক্ষা বিকাল ৫ কি ৬ টার দিকে। তো পরীক্ষা শেষ। ক্যারেনের প্রশ্নঃ
বেগ, কি লাইব্রেরীতে যাবে না কি বাসায়?
মনে মনে বললাম, হায়রে চাইনিজ, খালি পড়া আর পড়া, আরে আজকে হল ছুটি ...
না, এখন বাসায় যাব। ডিনার করে একটা মুভি তারপর ঘুম।
তাহলে, ৮ টার দিকে ‘সাজান উতামা’ (উনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের নিকট সবচেয়ে চালু দোকান) - তে চলে এসো। এক সঙ্গে ডিনার করবো।
বলে কি এই মেয়ে। এক সাথে ডিনার। পোলাপান (আমাদের সেই গ্রুপ) জানলে তো আমার খবর আছে। একটু ভেবে বললাম, ওকে।     
যাহোক, সাড়ে ৮ টা কি ৯ টার মধ্যে খাওয়া শেষ। এবার বাসায় ফেরার পালা। মেয়েটির ছাই রঙের নিজস্ব গাড়ি ছিল। আমাকে বাসায় নামিয়ে দেবে বলে গাড়িতে ওঠার অনুরোধ করল। আমার বাসায় যাওয়ার দুই রোড আগে মসজিদ ও ছোট পার্ক পাশাপাশি। এটি ছিল মূলত আমার বাসার নিকটতম মসজিদ। মালয়েশিয়ান ভাষায় একে “ছুরাও” বলে। অর্থাৎ জুম্মা বাদে শুধু ৫ ওয়াক্তের নামাজ এখানে হয়।
মেয়েটি পার্কের সামনে এসেই গাড়ি থামাল। বলল, এসো, কিছুক্ষন গল্প করি। আমারও ‘না’ নেই। যেহেতু আজ পড়াশুনারও কোন প্লান নেই। আর তাছাড়া হঠাৎ করে পার্কে বসে বিদেশি তরুণীর সাথে আড্ডা দেওয়াকে আমি তো কোন সমস্যা দেখতে পাচ্ছি না।
আমরা একটি কংক্রিটের বেঞ্চে বসলাম। গল্পের টপিক সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হচ্ছে আর স্পর্শকাতর বিষয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। একপর্যায়ে মেয়েটি বলল, “চল, আমার বাসায় যাই, আমি বাসায় একা”। আমার বুঝতে বাকি রইল না, এটা কিসের সিগন্যাল।
এবার শুরু হল আমার মনের মাঝে যুদ্ধ। আমি মনে মনে ভাবলাম, আমার সামনেই দূরে মসজিদ। আর এই মসজিদের সামনে বসে আমি এমন একটি প্রস্তাবে রাজী হয়ে যাব!! অন্যদিকে শয়তান আমার মনে উকি মেরে বলে, “এরকম চাইনিজ শাদা মাল সবসময় পাবে না, আর তাছাড়া বাসায় গেলেই কি সব হয়ে গেল!!!” আবার মনে মনে ভাবলাম, আমার নাম “আমিনুল ইসলাম” অর্থ ‘ইসলামে বিশ্বাসী’। হয়তো আমি ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি না, তাই বলে আমি এ রকম একটা পাপের মওকা বেছে নেব।
‘কি যাবে না? চল...’ আমার চিন্তায় ছেদ পড়ল। হুট করে আমি বললাম, ‘আমাকে রাতে আবার দেশে ফোন করতে হবে, সো মে বি নেক্সট টাইম’।
আমি তাকে সেখানেই বিদায় জানিয়ে হেঁটে বাসার দিকে রওনা দিলাম। আর আমি চিন্তা করতে লাগলাম, আসলে মুসলিম হিসাবে আমার অবস্থান কোন পর্যায়ে। মাথা থেকে পা পর্যন্ত চেহারা বা বেশ ভুষায় কোন চিহ্ন নেই। নাম জিজ্ঞেস না করলে তো বুঝা যাবে না মুসলমান নাকি অমুসলমান। পরিচয়হীনভাবে রাস্তায় মরে পড়ে থাকলে দাফন করতে গেলেও বিশেষাঙ্গ দেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোন রীতিতে দাফন হবে। আর এটা আমার কি অবস্থা যে, যে মসজিদের পাশের পার্কে বসেই মেয়েটি আমাকে এমন একটা প্রস্তাব দিল, সেই মসজিদটির ভিতরে কেমন আমি জানি না, অথচ আমি ইতিমধ্যে একবছরের বেশি সময় হল এই বাসায় উঠেছি।
এসব ভাবতে ভাবতে বাসায় পৌঁছে গেলাম। আমাদের বাসার রেজাউলকে বলতে সে আমাকে বলল, আল্লাহ তোমাকে তো অনেক বড় পাপ থেকে বাঁচিয়েছে। আরশের নিচে ছায়া সংক্রান্ত একটা হাদিসও সুনিয়ে দিল। আমি হেসে বললাম, বেটা ফাজলামি কর। এর মধ্যে অন্যান্য বন্ধুরাও এল। মওকা হাত ছাড়া করার কথা শুনে নানা রকম হাস্য কৌতুক করতে লাগল।
আমাদের মধ্যে নামজী বন্ধু ফুয়াদকে ফোন দিলাম, তোমার কাছে কি বাংলা অর্থসহ কোরআন শরীফ আছে? ফুয়াদ উত্তর দিল, তোমার মাথা ঠিক আছে তো”? যাই হোক শুরু করলাম ১ম সূরা থেকে আমার অর্থসহ কুরআন পড়া। শুরু হলো নামমাত্র জুম্মার মুসলমান থেকে বুঝে শুনে ইসলামে ধর্মান্তর। সূরা ফাতেহার অর্থ পড়েই নিজের সাথে মিল খুজে পেলাম না। সাহস নিয়ে শুরু করলাম পরবর্তী সূরা। প্রতিদিন মোহাচ্ছন্নভাবে পড়ে যাচ্ছি ব্যাখ্যাসহ মারেফুল কুরআন। সিদ্ধান্ত নিলাম দাঁড়ি না কাঁটার।
সেমিস্টার ব্রেকে এক মসজিদ থেকে আরেক মসজিদে জামাত বদ্ধভাবে ছুটে চলা, যা কিনা নিজের চিন্তা চেতনা, বেশ ভুষা, চেহারা, লাইফ স্টাইলে আনল অনেক পরিবর্তন।
এখন আমার কাছে পার্কের পাশের সেই মসজিদের একটা চাবি থাকে। আছরের সময় কিংবা ফজরের সময় আজানও আমার ভাগে পড়ে মাঝে মাঝে।
৩ সপ্তাহের সেমিস্টার ব্রেকের পরে যে সেমিস্টার ছিল, সেটা ছিল আমাদের ইনটেকের জন্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেইনিং এর জন্য। আগের কোন এক সেমিস্টারের অধিক ঘুমের কারণে ফাইনাল পরীক্ষা মিস করার খেসারত দিতে গিয়ে একটা সাবজেক্ট রেজিস্টার করতে হল।
মোটামুটি ৫ মাস পড়ে ক্লাসের সবার সাথে দেখা। ক্যারেনের সাথে দেখা। আমার দিকে তাকিয়ে মুখে হাত দিয়ে অবাক হয়ে বলল, “হোয়াট হ্যাপেন্ড টু ইউ? হোয়াট হ্যাপেন্ড টু ইওর ফেস”? মূলত মুখে দাঁড়ির দিকে লক্ষ্য করে বলল।
আমি হেসে বললাম, “গড হ্যাজ শোন মার্ছি টু মি”।
কারণ, আমার রব আমাকে দৃঢ়তার সাথে ইতিমধ্যে বুঝিয়ে দিয়েছেন,
“তিনি যাকে ইচ্ছা নিজের বিশেষ অনুগ্রহ দান করেন। আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল”। (সূরা আল ইমরানঃ ৭৪)

No comments:

Post a Comment