কবে আমাদের বোধোদয় হবে?
সমপ্রতি এমন কিছু ঘটনা পত্রিকার পাতায় এসেছে, যা একদিকে যেমন মর্মান্তিক
অন্যদিকে তেমনি উদ্বেগজনক। আমাদের তরুণ-সমাজের অধঃপতন সর্বগ্রাসী
ভোগ-প্রবণতা শুধু তাদেরকেই নিঃশেষ করে দিচ্ছে না; চারপাশের মানুষের জন্যও
আতঙ্ক ও অশান্তি তৈরি করছে। তবে একটি চরম সত্য এই যে, এই পরিণতিগুলো অভাবিত
নয়। পথিক যে গন্তব্যের দিকে পথচলা শুরু করে সেখানে পৌঁছে গেলে তার অবাক
হওয়ার কিছু নেই। এ তো তার পথ চলারই অনিবার্য পরিণতি।
পাশ্চাত্যের পুতি গন্ধময় সংস্কৃতিতে আমাদের গোটা সমাজ দুষিত ও বিষাক্ত হয়ে
পড়েছে। পাশ্চাত্যের ভোগবাদ আমাদের মুসলিম দেশুগুলোতেও এমনভাবে বিস্তৃত
হয়েছে যে, এখন মুসলমানিত্বের পরিচয় খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর হয়ে পড়েছে।
চিন্তা-চেতনা এবং আচরণ-উচ্চারণে পাশ্চাত্যের অনুগামীতাই প্রকট হয়ে উঠেছে।
আর সবচেয়ে মর্মান্তিক বিষয় এই যে, এই বিষয়গুলো এখন কারো ব্যক্তিগত বিষয় নয়;
বরং তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। এর অনিবার্য পরিণতি এই হয়েছে যে,
পরিবার ও সমাজ এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও শিশু-কিশোররা নৈতিক উন্নতির কোনো
উপাদান পায় না। একজন সৎ ও হৃদয়বান মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য চরিত্র ও
নৈতিকতার যে মজবুত ভীত রচনা করা প্রয়োজন, দুঃখজনভাবে আমাদের
শিক্ষা-ব্যবস্থা ও সমাজ-ব্যবস্থায় তার কোনো আয়োজন নেই। সুনির্দিষ্ট ও
পূর্ণাঙ্গ কোনো আদর্শ শিক্ষার্থীদের সামনে নেই। ফলে তারা ভাষা ও কৌশল রপ্ত
করছে, কিন্তু হৃদয়বৃত্তি ও চারিত্রিক পবিত্রতা তাদের মাঝে তৈরি হচ্ছে না।
স্নেহ-মমতা, ক্ষমা ও সহনশীলতা এবং ধৈর্য ও পরমতসহিষ্ণুতার মতো গুণাবলি
নিতান্তই
সেকেলে ও অপ্রয়োজনীয়। পুঁজিবাদী বিশ্ব-ব্যবস্থায় ভোক্তার প্রয়োজনটাই বড়।
তাই আমাদের আরোপিত শিক্ষা-ব্যবস্থাও বিশ্ব-নিয়ন্ত্রক শক্তিদের
লক্ষ্য-উদ্দেশ্যই বাস্তবায়িত হচ্ছে।
বস্তুত এই শিক্ষা-ব্যবস্থা একটি বিশাল ভোক্তা শ্রেণীই তৈরি করে যাচ্ছে।
সমাজের সর্বস্তরে ভোগবাদ এতই প্রকট হয়ে উঠেছে যে, অসংযমের যুপকাষ্ঠে বলি
হয়ে যাচ্ছে সকল নীতি ও নৈতিকতা এবং সকল মানবীয় গুণাবলি। অর্থ-বিত্ত এবং
ক্ষমতা ও নারীসঙ্গই এখন সমাজের একটি বিশাল শ্রেণীর আরাধ্য হয়ে ওঠেছে।
তবে এর চেয়েও ভয়াবহ বিষয় এই যে, প্রচার-প্রচারণার সকল উপকরণ সর্বোপরি গোটা
সমাজ-ব্যবস্থা একযোগে এই ধারাকেই উৎসাহিত করছে।
অন্যদিকে নীতি ও নৈতিকতা চর্চার যে ধারাটি ক্ষীণ হলেও স্বকীয় শক্তিতে
প্রবহমান তারও উজানে বাঁধ দিয়ে তা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়ার সকল চেষ্টা
অব্যাহত রয়েছে। মিডিয়া ও প্রচার-মাধ্যমগুলোর সর্বশক্তি নিয়োজিত করা হয়েছে
সুনীতি ও সুস্থ জীবন বোধ চর্চার এই ধারাকে নিরুৎসাহিত ও নির্বাপিত করার
জন্য। অবজ্ঞা ও অপবাদ এবং মিথ্যারোপ ও মিথ্যাচারের সকল অপকৌশল যেন উৎসর্গ
করে দেওয়া হয়েছে এই উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য।
একজন শিশু এই পরিবেশেই চোখ মেলছে এবং এই বিষাক্ত পরিবেশে তার দৈহিক ও
মানসিক বৃদ্ধি ঘটছে। চারপাশের এই যুগল ধারা থেকে তার হাতে খড়ি হচ্ছে
ভোগবাদে এবং হিংস্রতায়। সে হয়ে উঠছে একজন হিংস্র ও বুদ্ধিমান ভোগবাদী।
এরই কিছু দৃষ্টান্ত যখন সংবাদপত্রে শিরোনাম হয় তখন আমরা উদ্বিগ্ন হই। সন্তান দ্বারা পিতা-মাতার নিহত হওয়ার সংবাদ অতি সমপ্রতি পত্রিকায় এলেও
এ ধরনের ঘটনা এই প্রথম নয়। এ ধরনের ঘটনায় আমরা মর্মাহত হলেও অবাক নই। তবে
আমরা এই ভেবে উদ্বিগ্ন যে, খুব দ্রুত আমরা তা ভুলে যাব।
পিছনের দীর্ঘ
ইতিহাস বলে; আমরা বড় বিস্মৃতিপ্রবণ জনগোষ্ঠী!
No comments:
Post a Comment