Saturday, November 23, 2013

পরাজিত হুনাইনের বিজয়ের ডাকঃ হে আনসারবৃন্দ! হে বৃক্ষতলে শপথকারীগণ!

মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী হুনাইনের পার্বত্য অঞ্চল আওতাস। আরবের বিখ্যাত হাওয়াযেন ও সাকিফ গোত্র তাদের অন্যান্য মিত্র গোত্রসহ বিরাট এক বাহিনী নিয়ে সেখানে এসে শিবির গেড়েছে। তারা চায়, মক্কাজয়ী ইসলামী শক্তির উপরে শেষ এবং চূড়ান্ত আঘাত হানতে। তারা সাথে করে নিয়ে এসেছে  তাদের নারী, শিশু এবং বৃদ্ধদেরকেও। উদেশ্য, এদের বিপদ ও ভবিষ্যত চিন্তা করে যাতে কেউ যুদ্ধের ময়দান পরিত্যাগ না করে। হাওয়াযেন ও সাকিফ গোত্রের বিখ্যাত তীরন্দাজরা গিরিপথ ও গিরিখাতগুলোতে গোপন অবস্থান গ্রহণ করেছে।

অষ্টম হিজরী। শাওয়াল মাস। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নেতৃতে ১২ হাজার সৈন্যের মুসলিম বাহিনী হাওয়াযেন ও সাকিফ বাহিনীর মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই প্রথমবারের মত একটি মিশ্র বাহিনীর নেতৃত দিলেন। মুসলিম বাহিনীতে সদ্য ইসলাম গ্রহণ কারী নও মুসলিম ছাড়াও প্রায় দু’হাজারের মত এমন লোক শামিল ছিল যারা তখনও ইসলাম গ্রহণ করেনি। বিশেষ করে মুসলিম সৈন্যদের অগ্রবর্তী বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন খালিদ ইবন অয়ালিদ। তাঁর অধীনে অধিকাংশই ছিল অতিমাত্রায় উৎসাহী নব্য দীক্ষিত তরুনের দল। সুসজ্জিত ও বিশাল বাহিনীর মনে সেদিন এমন একটি ভাবের সৃষ্টি হলোঃ ‘আজ আমদের সাথে যুদ্ধে জয়ী হয় এমন সাধ্য কার?’

যুদ্ধ শুরু হলো। হয়াযানের তীর বৃষ্টি গোটা প্রান্তরকে ছেয়ে ফেলল। অগ্রবর্তী বাহিনীতে বিশৃংখলা দেখা দিল। সে বিশৃংখলা সংক্রামক হয়ে ছড়িয়ে পড়ল গোটা বাহিনীতে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সবাই ছুটে পালাতে লাগল। সমগ্র যুদ্ধের ময়দানে শুধু এক ব্যক্তি তাঁর জায়গায় স্থির ও অটলভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। ময়দানের এক প্রান্তে তখন হযরত উমার (রাঃ)। তলোয়ার থেকে একজন কাফিরের রক্ত মুছতে মুছতে আবু কাতাদাহ (রাঃ) তাঁর সমিপবর্তী হয়ে বললেন, “মুসলমানদের অবস্থা কি?” সিংহ হৃদয় হযরত উমার (রাঃ) অবনত মুখে শান্ত কন্ঠে বললেন, “এটাই আল্লাহর ফয়সালা ছিল।”

বৃষ্টির অবিরাম ধারার মত তীর ছুটে আসছে। এই তীরবৃষ্টির মধ্যে যুদ্ধের ময়দানে দাঁড়িয়ে আছেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তিনি চারিদিকে চোখ ফিরিয়ে দেখলেনঃ শুন্য মাঠ কেউ কথাও নেই। তিনি ধীরে ধীরে দক্ষিণ দিকে চোখ ফিরালেন। তাঁর দরাজকন্ঠে ধ্বনিত হলোঃ ‘হে আনসারবৃন্দ!’ সঙ্গে সঙ্গে সে শুন্য প্রান্তর পেরিয়ে উত্তর এলঃ ‘আমরা উপস্থিত আছি।’ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাম দিকে তাকিয়ে সে একই আহবান জানালেন। দক্ষিনের সে উত্তর এল বাম দিক থকেও। এরপর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বাহন থেকে নেমে পড়লেন। এসময় হযরত আব্বাস (রাঃ) এসে পড়লেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশে হযরত আব্বাসের (রাঃ) সুউচ্চকন্ঠে ধ্বনিত হলো, “হে আনসারবৃন্দ ! হে বৃক্ষতলে শপথকারীগণ।”

এই মর্মস্পশী আহবান কর্ণকুহরে পৌছার সাথে সাথে ঝড়ের বেগে মুসলমান সৈন্যদল যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে এল। সর্বাগ্রে পৌছার আকাংখায় এমন ভিড় জমে গেল যে, অনেকের পক্ষে ঘোড়ায় চড়ে আসা সম্ভব হল না। তারা ঘোড়া ফেলে রেখে আবার অনেকে শরীরটকে হালকা করার জন্য গায়ের বর্ম ছুড়ে ফেলে দিয়ে পাগলের মত ছুটে এল যুদ্ধ ক্ষেত্রে। অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যায় কিছু নিখাদ হয়ে ফিরে আসা মুসলিম বাহিনী বদর, উহুদ ও খন্দকের সেই রূপ আবার ফিরে পেল। মুহূর্তে ঘুরে গেল যুদ্ধের মোড়।  সমগ্র আরবের অদ্বিতীয় দুর্ধর্ষ তীরন্দাজ হাওয়াযেন ও সাকিফদের তীরের প্রাচীরও আর মুসলমানদের অগ্রগতি রোধ করতে পারলো না।  সাকীফ গোত্রের প্রধান সেনানায়ক উসমান ইবন আবদুল্লাহ নিহত হলো। শত্রুপক্ষ রণে ভংগ দিয়ে পালাল। যারা পালাতে পারল না তারা বন্দী হলো। এই হুনাইনের যুদ্ধে ছ’হাজার শত্রু বন্দী হল এবং চব্বিশ হাজার উট, চল্লিশ হাজার ছাগ-ছাগী ও চার হাজার উকিয়া চান্দী মুসলমানদের হাতে এসে পড়ল।

No comments:

Post a Comment