Saturday, November 16, 2013

বাবলা তলার শপথ



৬ষ্ঠ হিজরীর জিলকদ মাস। হজ্জযাত্রার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে আরবে দিকে দিকে। এই মাস থেকে আগামী তিন মাস মক্কাভূমিতে যুদ্ধ বিগ্রহ বন্ধ থাকবে, ভুলে থাকবে মানুষ তাদের দ্বেষ-দন্দ্বের কথা। এই উপলক্ষে মহানবী (সাঃ) মক্কায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ঘোষণা করে দিলেন তাঁর সিদ্ধান্তের কথা। আনন্দ আর উৎসাহের বন্যা বয়ে গেল মদীনায়। 

নির্দিষ্ট দিন এলো। যাত্রা করলেন মহানবী (সাঃ)। তিনি তাঁর প্রিয় উট কাসওয়ার পিঠে সমাসীন। সাথে চৌদ্দশ’ সাহাবা। যোদ্ধা নয় তীর্থযাত্রীর বেশ তাদের। সংগে কুরবানীর ৭০টি উট। ছয় বছর আগে মদীনায় প্রবেশ করার পর এই প্রথম তিনি যাত্রা করলেন মক্কার উদ্দেশ্যে কাবা’র পথে। 

তিনি মক্কার সন্নিকটবর্তী ‘আসফান’ নামক স্থানে পৌঁছে শুনতে পেলেন, কুরাইশরা যুদ্ধের জন্য এগিয়ে আসছে। কিন্তু মহানবী (সাঃ) তো কোন যুদ্ধের জন্য আসেননি। তিনি সোজাসুজি কুরাইশদের সম্মুখীন না হয়ে অন্য পথ ধরে মক্কার এক মঞ্জিল দূরে হুদাইবিয়া নামক গ্রামে গিয়ে উপস্থিত। স্থানীয় ‘খোজা’ গোত্রের দল নেতা বুদাইলের কাছ থেকে তিনি জানতে পারলেন যে, কুরাইশরা তাঁকে কিছুতেই মক্কা প্রবেশ করতে দেবে না, প্রয়োজন হলে যুদ্ধের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত তারা। মহানবী (সাঃ) বুদাইলকে পাঠিয়ে কুরাইশদেরকে তাঁর শান্তি কামিতা ও আগমনের উদ্দেশ্যের কথা জানালেনকিন্তু ফল কিছুই হলো না। মুসলমানদের পর্যবেক্ষণের জন্য ‘ওবওয়া’ ও ‘বেদওয়া’ গোত্রের দলনেতাসহ কয়েক ব্যক্তি হুদাইবিয়া গ্রামে এলো। তারাও গিয়ে মহানবী (সাঃ) এর সদিচ্ছা সম্পর্কে কুরাইশদেরকে অবহিত করল। কিন্তু তাদের গোঁ দূর হলোনা। মহানবী (সাঃ) তাঁর সদিচ্ছার নিদর্শন হিসেবে তাঁর প্রিয় উট কাসোয়ার পিঠে খিরাশ নামক সাহাবীকে মক্কায় পাঠালেন। কিন্তু তাঁর এ শুভেচ্ছার জবাব তারা দিলো মহানবী (সাঃ) এর উটের ক্ষতি সাধন করে। আর কয়েকটি গোত্রের হস্তুক্ষেপে ‘খিরাশ’ কোন রকমে প্রাণ নিয়ে ফিরে এলেন হুদাইবিয়ায়।

অবশেষে মহানবী (সাঃ) হযরত উসমান (রাঃ) কে কুরাইশদের সাথে কথা বলবার জন্য মক্কায় পাঠালেন। আলোচনার ফলাফল জানবার জন্য মুসলমানরা হযরত উসমান (রাঃ) এর পথের দিকে চেয়ে রইলেন-গড়িয়ে গেল ঘণ্টার পর ঘন্টা। কিন্তু হযরত উসমান (রাঃ) এর দেখা নেই-দিগন্ত বিস্তৃত শুন্য মরুপথ নির্জন পড়ে আছে সামনে। উদ্বেগ ও আশংকা ছড়িয়ে পড়ল গোটা কাফিলায়। এমন সময় খবর এলঃ হযরত উসমান  (রাঃ) নিহত হয়েছেন।

শোকের বিদ্যুৎ তরঙ্গ খেলে গেল প্রতিটি মুসলমানের হৃদয়তন্ত্রীতে। বিশিষ্ট সাহাবী মহানবী (সাঃ) এর জামাতা, ইসলামের অতন্ত্র সৈনিক হযরত উসমান (রাঃ) এর শোকে মুহ্যমান মুসলমানদের কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে গেলঃ এ তো উসমান (রাঃ) এর হত্যা নয়-সত্যের হত্যা। সত্য ও মিথ্যার চিরন্তন বিরধেরই এ একটি আংশিক প্রকাশ মাত্র। কেন তাঁরা এ আঘাতকে নিরবে সহ্য করে যাবে? উত্তেজনা ও শপথে দৃপ্ত হয়ে উঠলো প্রতিটি মুসলমান।

মহানবী (সাঃ) এর দৃঢ় কন্ঠ ধ্বনিত হলঃ “আমদেরকে অবশ্যই উসমান (রাঃ) এর রক্তের বদলা নিতে হবে।” মহানবী (সাঃ) এর এই উক্তি হুদাইবিয়ায় উপস্থিত ১৪০০ বিশ্বাসীর হৃদয়কে আত্মোৎসর্গের প্রেরণায় আকুল করে তুলল।

মহানবী (সাঃ) একটি বাবলা গাছের নিচে গিয়ে বসলেন। দৃপ্ত শপথে দৃঢ় ১৪০০ সৈনিক একে একে মহানবী (সাঃ) এর হাতে হাত রেখে শপথ নিলেন, “হযরত উসমান  (রাঃ) হত্যার বদলা আমরা নেব। আমরা মরে যাব, তবু লড়াইয়ের মাঠ থেকে পিছু হটব না।”

শ্ত্রু দেশে শ্ত্রু পরিবেষ্টিত অবস্থায় ১৪০০ মুজাহিদ। যুদ্ধের জন্য কোন অস্ত্রশস্ত্রই তাদের কাছে নেই, আছে শুধু আত্মরক্ষার জন্য একটি করে তরবারি। তবু শত্রুর মুকাবিলা ও অন্যায় প্রতিকারেরই শপথ নিলেন তাঁরা। তাঁদের এ শপথের নির্ভরতা ছিল অস্ত্রের উপর নয়- ঈমানের উপর, ঈমানী শক্তির উপর। আর ঈমানের শক্তি অস্ত্র বলের চাইতে বহুগুনে শক্তিশালী, বাবলা গছের সেই শপথ তা ক্ষণকাল পরেই প্রমাণ করে দিল প্রমাণ করে দিল, অন্যায়ের প্রতিরোধ আর ন্যায় প্রতিষ্ঠায় মুসলমানরা যদি আত্মোৎসর্গিত হয়, তাহলে আল্লাহর সাহায্য কত দ্রুত নেমে আসে।



মুসলমানদের শপথের কথা যথা সময়ে মক্কায় পৌঁছল। কুরাইশ বিবেক এবার চঞ্চল হয়ে উঠল। মুসলমানদের প্রয়োজনীয় যুদ্ধাস্ত্র না থাকলেও এবং তাঁরা সংখ্যায় অতি নগণ্য হলেও তাঁদের ভীষণ শপথের কথা কুরাইশদের ভীত করে তুলল। তারা মুসলমানদের শৌর্য-বীর্য দেখেছে। জেনেছে তারা যে, মুসলমানরা না মেরে মারা যায় না। সুতরাং তারা তাদের ভুল সংশোধন করল। বন্দীদশা থেকে ছেড়ে দিল উসমান (রাঃ) কে আর তার সাথে সাথে কুরাইশরা বাড়িয়ে দিল সন্ধির হাত মুসলমানদের কাছে। মহানবী (সাঃ) এর সাথে হুদাইবিয়া গ্রামে এসে সাক্ষাত করলো কুরাইশ প্রতিনিধিরা।

বারবার প্রতিনিধি প্রেরণ এবং পুনঃপুনঃ অনুরোধ কুরাইশদের যে যুদ্ধতৃষ্ণা মেটাতে পারেনি, পারেনি তাদের বিবেক বোধ জাগ্রত করতে, ঈমান দীপ্ত বাবলাতলার শপথ তা সম্ভব করে দিল।

No comments:

Post a Comment