Wednesday, October 30, 2013

নীতিই সব কিছুর উর্ধে স্থান পেলো



মক্কার কিছু দূরে হুদাইবিয়া গ্রাম। বিরাট এক বৈঠক বসেছে। বৈঠকে রয়েছেন মহানবী (সাঃ) এবং উল্লেখযোগ্য সব সাহাবী (রাঃ)। মুশরিক কুরাইশদের পক্ষ থেকে রয়েছে কয়েকজন প্রভাবশালী সরদার। হুদাইবিয়া সন্ধির শর্তাবলী চূড়ান্ত হয়েছে। কিন্তু তখন লিখা শুরু হয়নি। 

এমন সময় মক্কা থেকে আবু জান্দাল (রাঃ) সেখানে হাজির হলো। তার হাতে পায়ে শিকল। সারা গায়ে তার নির্যাতনের চিহ্ন। মুসলমান হয়ার অপরাধে তাকে আটকে রাখা হয়েছিল। পুনরায় পৌত্তালিক ধর্মে তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য তার আত্মীয়-স্বজন তার উপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছে। কত দিন আর নির্যাতন সইবে সে। মুক্তির আশায় সে পাগল হয়ে উঠেছিল। এই সময় সে জানতে পারে, মহানবী (সাঃ) তাঁর চৌদ্দশ’ সাহাবাসহ হুদাইবিয়া পর্যন্ত এসে যাত্রা বিরত করেছেন। অনেক আশা তার মনে, একবার কোন ক্রমে যদি মহানবী (সাঃ) এর কাছে গিয়ে পৌঁছতে পারে, তাহলে তার জীবনে এসে যাবে চির মুক্তির সুবহে সাদিক। আবু জান্দাল (রাঃ) হুদাইবিয়ার সে বৈঠকে হাজির হয়ে মহানবী (সাঃ) কে তার সব কথা জানিয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করল। আবু জান্দাল (রাঃ) এর নির্যাতনের কাহিনী শুনে উপস্থিত মুসলমানদের মনে বেদনার তরঙ্গ বয়ে গেল।

আবু জান্দাল (রাঃ) হুদাইবিয়ার সে বৈঠকে পৌঁছার পর পরই আবু জান্দাল (রাঃ) এর পিতা তার মুখে কয়েকটি চপেটাঘাত করল এবং আবু জান্দাল (রাঃ) কে তার হাতে ফিরিয়ে দেবার জন্য মহানবী (সাঃ) এর কাছে দাবি জানাল সে বলল হুদাইবিয়া সন্ধির শর্তানুসারে আবু জান্দাল (রাঃ) কে আপনারা রাখতে পারবেন না। তাকে আপনারা ফিরিয়ে দিতে বাধ্য। (হুদাইবিয়ার সন্ধির একটি শর্ত ছিল, মক্কার কোন লোক মুসলমান হয়ে কিংবা অন্যভাবে মুসলমানদের আশ্রয়ে গেলে তাকে মক্কাবাসীদের হাতে ফিরিয়ে দিতে হবে)। 

সুহাইলের কথা শুনে মহানবী (সাঃ) বললেন, ‘সন্ধি এখনও লিখিত হুয়নি, স্বাক্ষর তো হয়ইনি। সুতরাং এর শর্ত এই মুহূর্তে মেনে নেয়া কি খুব জরুরী?’

সুহাইল কিন্তু নাছোড় বান্দা। সে বলল, ‘সন্ধি লিখিত ও স্বাক্ষরিত না হলেও কথা তো পাকাপাকি হয়ে গেছে। সুতরাং আবু জান্দাল (রাঃ) কে আমি অবশ্যই ফিরে পাব।’

মহানবী (সাঃ) সুহাইলের কথার জবাব দিলেন না। সুহাইলের কথা যে অমুলক নয়, তা তিনি জানেন। উভয় পক্ষে স্বীকৃত ও নির্দিষ্ট হয়ে গেছে, তা অস্বীকার করা যায় না। চিন্তিত হলেন তিনি। মহানবী (সাঃ) কে নীরব থাকতে দেখে মুসলমানরাও আশংকিত হয়ে পড়লেন। কি জানি, তাদের এক ভাইকে নাকি আবার কাফিরদের হাতে ফিরিয়ে দিতে হয়। মহানবী (সাঃ) অত্যন্ত নরম ভাষায় আবু জান্দালকে ফেরত না চাইবার জন্য সুহাইলকে অনুরোধ জানালেন। কিন্তু মহানবীর বিনীত প্রার্থনাতেও সুহাইলের মন গলল না। মহানবী (সাঃ) এর সামনে তখন উভয় সংকট। একদিকে সন্ধির সর্ত রক্ষা, অন্যদিকে একজন মুসলমানকে কাফিরদের হাতে ফেরত না দেয়া। সন্ধির শর্ত যেহেতু আগেই নির্ধারিত হয়েছে, তাই সন্ধির শর্ত, পালনই বড় হয়ে উঠল। আবু জান্দাল (রাঃ) যখন বুঝল যে, তাকে পুনরায় কাফির দের হাতে ফিরিয়ে দেয়া হবে, তখন সে করুণভাবে কেঁদে উঠল। বলল, “আমি মুসলমান হয়ে আপনাদের আশ্রয় নিলাম। আর আপনারা আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন। কত অত্যাচার, কত যন্ত্রণা যে আমাকে ভোগ করতে করতে হয়, তাতো আপনারা জানেন না।”

আবু জান্দালের কথা শুনে উপস্থিত প্রতিটি মুসলমানের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। মন তাদের বিদ্রোহী হয়ে উঠতে চায়, না আমাদের ভাই কে আমরা ফিরিয়ে দেব না। দরকার হলে, তাঁকে রক্ষার জন্য যে কোন পরিস্থিতির মুকাবিলা করব। কিন্তু মহানবী (সাঃ) সৌম্য শান্ত ভাবনার গভীর নিমজ্জিত মুখের দিকে চেয়ে তারা কিছুই বলতে পারল না। 

ব্যথা-বেদনার রাজপথ বেয়ে আবু জান্দাল (রাঃ) কে বিদায় দেবার সময় মহানবী (সাঃ) তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “আবু জান্দাল (রাঃ), আল্লাহর নামে ধৈর্য ধর, আল্লাহুই তোমার মুক্তির ব্যবস্থা করে দিবেন।” চোখ মুছে আবু জান্দাল (রাঃ) আবার ফিরে চলল মক্কায়। 

ন্যায়বিচার ও স্বীকৃত নীতিবোধকে এ ভাবেই মুসলমানরা সব সময় সবার উর্ধে স্থান দিয়েছেন।

No comments:

Post a Comment