Friday, September 13, 2013

আপনি কি সাম্প্রদায়িক?

আমাদের দেশে তথা সারা বিশ্বে যখন কোনো একদল লোক নিজের বিশ্বাসের পরিবর্তে কোন একটি ভাষা বা ভৌগলিক অঞ্চল কে ভিত্তি করে দলাদলি করে তখন এর নাম হয় দেশপ্রেম, patriotiism, nationalism , জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি । যারা এমন করে তাদের কে বলা হয় দেশপ্রেমিক বা জাতীয়তাবাদী । সমাজে ও মিডিয়াতে একে খুব পসিটিভ দৃষ্টি তে দেখা হয় । এরা অন্য ভৌগলিক অঞ্চল বা ভাষার লোক কে পর মনে করে নিজের ভৌগলিক অঞ্চল বা ভাষার লোকদের আপন মনে করে । দরকার হলে অন্য ভৌগলিক অঞ্চল বা ভাষার লোকদের উপর নিজের শ্রেষ্টত্ত জাহির করতে ভুল করেনা, প্রয়োজনে তাদের সাথে যুদ্ধ করতেও বাধেনা । কিন্তু এরা আবার চায় যে নিজ ভৌগলিক অঞ্চল বা ভাষার লোকদের মধ্যে ধর্মের জন্য কোনো দলাদলি না হোক ।

পৃথিবীর অন্যন্য দেশের মত বাংলাদেশ এরকম লোকে ভরপুর । সীমান্তের ওপাশে বৌদ্ধরা মুসলিম মারলে তাদের কষ্ট হয়না কারন মুসলিম রোহিঙ্গা রা তো আর বাঙালি বা বাংলাদেশী না । কিন্তু সীমান্তের এপাশে মুসলিমরা বৌদ্ধ মারলে তাদের বেশ কষ্ট হয় কারণ ওই বৌদ্ধরা তো বাঙালি বা বাংলাদেশী । তারা মানববন্ধন, প্রেস ইভেন্ট ইত্যাদি করে । তারা বিশ্ব মানবতার কথা বলে ঠিকই কিন্তু খালি বাঙালি বাংলাদেশী মরলেই তাদের দু:খ উথলিয়ে উঠে । তাদের এই মায়া যে খালি এই ভুখন্ডের বাঙালি বাংলাদেশীদের জন্য তাও না, দূর দেশে যেখানেই তারা থাকুক তাদের জন্য তাদের সমান মায়া । লিবিয়ার সংঘাতে এত লোক মারা গেল তাতে তাদের ভ্রুক্ষেপ হয়নি কিন্তু ওখানের গুটিকয়েক বাংলাদেশী ঠিক মত দেশে ফিরল নাকি তা নিই তাদের চিন্তা । এরা চায় এই ভাষার ও ভুখন্ডের লোকদের মধ্যে কোনো রকম বিদ্বেষ না থাকুক - 'বাংলার মুসলিম , বাংলার হিন্দু , বাংলার বৌদ্ধ , বাংলার খৃষ্ঠান - আমরা সবাই বাঙালি' - এ হলো তাদের স্লোগান । কিন্তু বাইরের দেশের লোকদের প্রতি বিদ্বেষ থাকলে কোনো সমস্যা নাই কারণ তারা তো আর বাঙালি না । তাই ইন্ডিয়া পাকিস্তান কে জাতি ধরে একবারে গালি দিলেও একে খারাপ মনে করা হয়না । তাদের কাছে বাঙালিত্ত আগে, ধর্ম পরে ।

পৃথিবীতে আরেকটি minority আছে যারা নিজেদের বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে দলাদলি করে । এদের কে বলা হয় সাম্প্রদায়িক । সমাজে ও মিডিয়াতে একে খুব নেগেটিভ দৃষ্টি তে দেখা হয় ।

আমাদের দেশেও এই minority গ্রুপ টি আছে । এরা নিজেদের সামগ্রিক মুসলিম উম্মাহর অংশ মনে করে । পৃথিবীর কথাও মুসলিম দের উপর আক্রমন বা নির্যাতন হলে তাদের প্রাণ কাঁদে যদিও তারা বাঙালি বা বাংলাদেশী না হয় । তাদের কাছে সব মুসলিম ই সমান সবাই তার ভাই বোন সে হোক বাঙালি বা রুশি বা ইন্ডিয়ান বা আফগানী । তারা মিশরের/সিরিয়ার/ইরাকের/ফিলিস্তিনের ... নির্যাতন ও হত্যা কে ঠিক সেভাবেই খেয়াল করে ও প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে যেভাবে তারা নিজের দেশের সীমান্তে নির্যাতন ও হত্যা কে খেয়াল করে ও প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে । তাদের কাছে ইসলামিক পরিচয় আগে, ভাষা বা ভৌগলিক পরিচয় পরে ।

এখন দেখা যাক মহান আল্লাহ তাআলা কুরআন শরীফে এ বিষয়ে কি বলেছেন :

১. মুসলিমদের সাথে সম্পর্কের বিষয়ে :

"আর তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে সুদৃঢ় হস্তে ধারণ কর; পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। আর তোমরা সে নেয়ামতের কথা স্মরণ কর, যা আল্লাহ তোমাদিগকে দান করেছেন। তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের মনে সম্প্রীতি দান করেছেন। ফলে, এখন তোমরা তাঁর অনুগ্রহের কারণে পরস্পর ভাই ভাই হয়েছ। তোমরা এক অগ্নিকুন্ডের পাড়ে অবস্থান করছিলে। অতঃপর তা থেকে তিনি তোমাদেরকে মুক্তি দিয়েছেন। এভাবেই আল্লাহ নিজের নিদর্শনসমুহ প্রকাশ করেন, যাতে তোমরা হেদায়েত প্রাপ্ত হতে পার।" (৩:১০৩)

"আর ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী একে অপরের সহায়ক। তারা ভাল কথার শিক্ষা দেয় এবং মন্দ থেকে বিরত রাখে। নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নির্দেশ অনুযায়ী জীবন যাপন করে। এদেরই উপর আল্লাহ তা’আলা দয়া করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশীল, সুকৌশলী।" (৯:৭১)

এ বিষয়ে একটি হাদিস :

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমরা মুমিনদেরকে পরস্পরে মিল-মহববত ও একে অন্যের প্রতি দয়া করার ক্ষেত্রে এক শরীরের ন্যায় দেখবে। তারা এমন একটি শরীরের মতো হবে, যখন তার একটি অঙ্গ কষ্ট পায় তখন সমস্ত শরীর ব্যথিত হয়ে যায়।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬০১১; মুসলিম, হাদীস : ২৫৮৬.

২. অমুসলিমদের সাথে সম্পর্কের বিষয়ে :

"মুমিনগন যেন অন্য মুমিনকে ছেড়ে কেন কাফেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যারা এরূপ করবে আল্লাহর সাথে তাদের কেন সম্পর্ক থাকবে না। তবে যদি তোমরা তাদের পক্ষ থেকে কোন অনিষ্টের আশঙ্কা কর, তবে তাদের সাথে সাবধানতার সাথে থাকবে আল্লাহ তা’আলা তাঁর সম্পর্কে তোমাদের সতর্ক করেছেন। এবং সবাই কে তাঁর কাছে ফিরে যেতে হবে।" (৩:২৮)

"হে ঈমানদারগণ! তোমরা মুমিন ব্যতীত অন্য কাউকে অন্তরঙ্গরূপে গ্রহণ করো না, তারা তোমাদের অমঙ্গল সাধনে কোন ক্রটি করে না-তোমরা কষ্টে থাক, তাতেই তাদের আনন্দ। শত্রুতাপ্রসুত বিদ্বেষ তাদের মুখেই ফুটে বেরোয়। আর যা কিছু তাদের মনে লুকিয়ে রয়েছে, তা আরো অনেকগুণ বেশী জঘন্য। তোমাদের জন্যে নিদর্শন বিশদভাবে বর্ণনা করে দেয়া হলো, যদি তোমরা তা অনুধাবন করতে সমর্থ হও।" (৩:১১৮)

"তারা চায় যে, তারা যেমন কাফের, তোমরাও তেমনি কাফের হয়ে যাও, যাতে তোমরা এবং তারা সব সমান হয়ে যাও। অতএব, তাদের মধ্যে কাউকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, যে পর্যন্ত না তারা আল্লাহর পথে হিজরত করে চলে আসে।" (৪:৮৯)

"যারা মুসলমানদের বর্জন করে কাফেরদেরকে নিজেদের বন্ধু বানিয়ে নেয় এবং তাদেরই কাছে সম্মান প্রত্যাশা করে, অথচ যাবতীয় সম্মান শুধুমাত্র আল্লাহরই জন্য।" (৪:১৩৯)

"হে ঈমানদারগণ! তোমরা কাফেরদেরকে বন্ধু বানিও না মুসলমানদের বাদ দিয়ে। তোমরা কি এমনটি করে নিজের উপর আল্লাহর প্রকাশ্য দলীল কায়েম করে দেবে?" (৪:১৪৪)

"হে মুমিণগণ! তোমরা ইহুদী ও খ্রীষ্টানদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ জালেমদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না।" (৫:৫১)

"হে মুমিনগণ, আহলে কিতাবদের মধ্য থেকে যারা তোমাদের ধর্মকে উপহাস ও খেলা মনে করে, তাদেরকে এবং অন্যান্য কাফেরকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করো না। আল্লাহকে ভয় কর, যদি তোমরা ঈমানদার হও।"(৫:৫৭)

"আপনি তাদের অনেককে দেখবেন, কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করে। তারা নিজেদের জন্য যা পাঠিয়েছে তা অবশ্যই মন্দ। তা এই যে, তাদের প্রতি আল্লাহ ক্রোধান্বিত হয়েছেন এবং তারা চিরকাল আযাবে থাকবে।"(৫:৮০)

"যদি তারা আল্লাহর প্রতি ও রসূলের প্রতি অবতীর্ণ বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করত, তবে কাফেরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করত না। কিন্তু তাদের মধ্যে অনেকেই দুরাচার।"(৫:৮১)

"তোমরা কি মনে কর যে, তোমাদের ছেড়ে দেয়া হবে এমনি, যতক্ষণ না আল্লাহ জেনে নেবেন তোমাদের কে যুদ্ধ করেছে এবং কে আল্লাহ, তাঁর রসূল ও মুসলমানদের ব্যতীত অন্য কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করা থেকে বিরত রয়েছে। আর তোমরা যা কর সে বিষয়ে আল্লাহ সবিশেষ অবহিত।" (৯:১৬)

"আপনি কি তাদের প্রতি লক্ষ্য করেননি, যারা আল্লাহর গযবে নিপতিত সম্প্রদায়ের সাথে বন্ধুত্ব করে? তারা মুসলমানদের দলভুক্ত নয় এবং তাদেরও দলভূক্ত নয়। তারা জেনেশুনে মিথ্যা বিষয়ে শপথ করে। "(৫৮:১৪)

"যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে, তাদেরকে আপনি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধাচরণকারীদের সাথে বন্ধুত্ব করতে দেখবেন না, যদিও তারা তাদের পিতা, পুত্র, ভ্রাতা অথবা জ্ঞাতি-গোষ্ঠী হয়। তাদের অন্তরে আল্লাহ ঈমান লিখে দিয়েছেন এবং তাদেরকে শক্তিশালী করেছেন তাঁর অদৃশ্য শক্তি দ্বারা। তিনি তাদেরকে জান্নাতে দাখিল করবেন, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত। তারা তথায় চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। তারাই আল্লাহর দল। জেনে রাখ, আল্লাহর দলই সফলকাম হবে। "(৫৮:২২)

"মুমিনগণ, তোমরা আমার ও তোমাদের শত্রুদেরকে বন্ধরূপে গ্রহণ করো না। তোমরা তো তাদের প্রতি বন্ধুত্বের বার্তা পাঠাও, অথচ তারা যে সত্য তোমাদের কাছে আগমন করেছে, তা অস্বীকার করছে। তারা রসূলকে ও তোমাদেরকে বহিস্কার করে এই অপরাধে যে, তোমরা তোমাদের পালনকর্তার প্রতি বিশ্বাস রাখ। যদি তোমরা আমার সন্তুষ্টিলাভের জন্যে এবং আমার পথে জেহাদ করার জন্যে বের হয়ে থাক, তবে কেন তাদের প্রতি গোপনে বন্ধুত্বের পয়গাম প্রেরণ করছ? তোমরা যা গোপন কর এবং যা প্রকাশ কর, ত আমি খুব জানি। তোমাদের মধ্যে যে এটা করে, সে সরলপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়। "(৬০:১)

"মুমিনগণ, আল্লাহ যে জাতির প্রতি রুষ্ট, তোমরা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করো না। তারা পরকাল সম্পর্কে নিরাশ হয়ে গেছে যেমন কবরস্থ কাফেররা নিরাশ হয়ে গেছে। "(৬০:১৩)

"ইহুদী ও খ্রীষ্টানরা কখনই আপনার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না, যে পর্যন্ত না আপনি তাদের ধর্মের অনুসরণ করেন। বলে দিন, যে পথ আল্লাহ প্রদর্শন করেন, তাই হল সরল পথ। যদি আপনি তাদের আকাঙ্খাসমূহের অনুসরণ করেন, ঐ জ্ঞান লাভের পর, যা আপনার কাছে পৌঁছেছে, তবে কেউ আল্লাহর কবল থেকে আপনার উদ্ধারকারী ও সাহায্যকারী নেই।" (২:১২০)

৩. খুব আপন অমুসলিমদের সাথে সম্পর্কের বিষয়ে :

"হে ঈমানদারগণ! তোমরা স্বীয় পিতা ও ভাইদের অভিভাবকরূপে গ্রহণ করো না, যদি তারা ঈমান অপেক্ষা কুফরকে ভালবাসে। আর তোমাদের যারা তাদের অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে তারা সীমালংঘনকারী।" (৯:২৩)

আর আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের জোর নির্দেশ দিয়েছি। তার মাতা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে। তার দুধ ছাড়ানো দু বছরে হয়। নির্দেশ দিয়েছি যে, আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমারই নিকট ফিরে আসতে হবে।পিতা-মাতা যদি তোমাকে আমার সাথে এমন বিষয়কে শরীক স্থির করতে পীড়াপীড়ি করে, যার জ্ঞান তোমার নেই; তবে তুমি তাদের কথা মানবে না এবং দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে সহঅবস্থান করবে। যে আমার অভিমুখী হয়, তার পথ অনুসরণ করবে। অতঃপর তোমাদের প্রত্যাবর্তন আমারই দিকে এবং তোমরা যা করতে, আমি সে বিষয়ে তোমাদেরকে জ্ঞাত করবো। (৩১:১৪)

"হে ঈমানদারগণ, তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাক; আল্লাহর ওয়াস্তে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্যদান কর, তাতে তোমাদের নিজের বা পিতা-মাতার অথবা নিকটবর্তী আত্নীয়-স্বজনের যদি ক্ষতি হয় তবুও। কেউ যদি ধনী কিংবা দরিদ্র হয়, তবে আল্লাহ তাদের শুভাকাঙ্খী তোমাদের চাইতে বেশী। অতএব, তোমরা বিচার করতে গিয়ে রিপুর কামনা-বাসনার অনুসরণ করো না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বল কিংবা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজ কর্ম সম্পর্কেই অবগত।" (৪:১৩৫)

আপনাদের কাছে আল্লাহর বাণী পেশ করলাম । এখন কোন ধরনের দলাদলি করবেন তা আপনার ইচ্ছা । কিন্তু যে ধরনের করবেন তার উপর নির্ভর করবে এই দুনিয়ায় ও আখিরাতে আপনার পরিনতি ।


আলোচকঃ মাশুক রহমান, কম্পিউটার প্রকৌশলী

No comments:

Post a Comment