Tuesday, June 25, 2013

বিশ্বজিৎ হত্যাকান্ড : ইসলাম কী বলে

কল্পনা করুন যদি এটি হতো একটি ইসলামী রাষ্ট্র, এতে যদি শরীয়া আইন থাকতো তবে বিশ্বজিৎ অন্তর্ভুক্ত হতেন সংখ্যালঘুদের তালিকায়। কিন্তু সেক্ষেত্রে হত্যাকারীদের ফাসির কাষ্ঠে ঝুলতে হয়ত এত বিলম্ব হত না। ইসলামের সংখ্যালঘু সংক্রান্ত আইনগুলো যাদের জানা আছে তারা বিষয়টি সহজেই উপলব্ধি করতে পারবেন। এখানে একজন সংখ্যালঘুর জান, মাল ও ইজ্জতের মূল্য একজন মুসলমান নাগরিকের সমান। শরীয়তের ভাষায়-

“ (অর্থ) তাদের (ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসকারী অমুসলিমগণ) রক্ত আমাদের রক্তের মত এবং তাদের সম্পদ আমাদের সম্পদের মত মর্যাদাদাশীল।“

সুতরাং দেশে ইসলামী শাসনব্যবস্থা থাকলে বিশ্বজিতের পরিবারকে তাদের প্রিয়জনের হত্যাকারীদের ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলন্ত দেখতে এতদিন অপেক্ষা করতে হত না। কারণ প্রকাশ্য দিবালোকে অসংখ্য মানুষের সামনে ঘটে যাওয়া এ ঘটনায় জড়িতদের খুঁজে বের করতে কোনোই অসুবিধা হত না। আর তারা স্বীকারোক্তি না দিলে সাক্ষীরও অভাব হত না। এভাবেই কার্যকর হত অপরাধীদের চরম পরিণতির রায়।

এবার নজর দেওয়া যাক এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে ইসলামের বিধি বিধানের দিকে। এ বিষয়টি মূলত: ‘আততাশরীউল জিনাইল ইসলামী’ তথা ইসলামের ফৌজদারী দন্ডবিধির আওতাভুক্ত বিষয়। আগেই বলেছি যে, কিছু অবোধ এবং কতক দুষ্ট লোকেরা এ বিষয়ে বিস্তর প্রোপাগান্ডা ছড়িয়েছে। তাই দরকার ছিল এ অধ্যায়টি বিস্তারিত আলোচনা করার। কিন্তু সামান্য পরিসরে তা তো সম্ভব হয়ে ওঠার নয়। তাই আমরা শুধু আলোচিত ঘটনার ক্ষেত্রে ইসলামী আইনে শাস্তির বিধানটি উল্লেখ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকব।

বিশ্বজিৎকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে এটি ইসলামী আইনে الحرابة (আলহিরাবাহ) বা قطع الطريق (কতউত তরীক) এর অন্তর্ভুক্ত। ‘আলহিরাবাহ’ বা ‘কতউত তরীক’ অর্থ হলো প্রকাশ্যে কাউকে হত্যা করা ও তার সম্পদ লুণ্ঠন করা অথবা এর যেকোনোটি সংঘটিত করা। কিংবা সশস্ত্র সন্ত্রাসের মাধ্যমে এসব কর্মের চেষ্টা করা যদিও জান-মালের ক্ষতি করতে সফল না হোক।

সংক্ষেপে বলতে গেলে প্রকাশ্যে সংঘটিত যেকোনো সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ‘আলহিরাবাহ’ এর অন্তর্ভূক্ত। কুরআনুল কারীমে ‘আলহিরাবাহ’ অপরাধ ও এর শাস্তি সম্পর্কে বিস্তারিত নির্দেশনা রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন :

“ যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত হয় এবং দেশে হাঙ্গামা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়, তাদের শাস্তি হচ্ছে এই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শুলিতে চড়ানো হবে অথবা তাদের হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কেটে দেওয়া হবে অথবা এলাকাছাড়া করা হবে। এটি হল তাদের জন্য ইহকালের লাঞ্ছনা আর পরকালে তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি।“ (সূরা আলমায়িদাহ, আয়াত : ৩৩)

উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের জন্য ৪টি শাস্তির ঘোষণা দিয়েছেন। এবং অপরাধের মাত্রা ও ধরন অনুযায়ী উক্ত ৪টি শাস্তি থেকে যার জন্য যেটা প্রযোজ্য তা নির্ধারণ করার দায়িত্ব বিচারকের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। যেমন কোনো সন্ত্রাসী কাউকে প্রকাশ্যে হত্যা করে যদি তার সম্পদও ছিনিয়ে নেয়, তবে তাকে হত্যাও করা হবে আবার শুলেও চড়ানো হবে। আবার কেউ যদি হত্যা না করে শুধু সম্পদ ছিনিয়ে নেয় সেক্ষেত্রে তার একদিকের হাত এবং অন্যদদেকের পা কেটে দেওয়া হবে। এভাবে অপরাধ ভেদে নির্ধারিত হবে ৪ শাস্তির কোনো ১টি।

কতল ও আলহিরাবাহ এক নয়
ইসলামের ফৌজদারী দন্ডবিধিতে হত্যা ও সন্ত্রাস তথা কতল ও আলহিরাবাহকে দু’টি পৃথক অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এবং প্রকাশ্যে কাউকে হত্যা করা বা প্রকাশ্যে কারো সম্পদ লুণ্ঠন সাধারণ হত্যা ও চুরি থেকে অনেক বেশি জঘন্য অপরাধ হিসেবে ধর্তব্য হয়েছে। এ কারণেই ‘আলহিরাবাহ’-এর শাস্তি অন্য যেকোনো শাস্তির চেয়ে কঠোর।

আলহিরাবাহ ক্ষমাযোগ্য নয়
শুধু তাই নয় বরং ইসলামী দন্ডবিধিতে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের (আলহিরাবাহ) কারণে প্রাপ্য শাস্তি ক্ষমাযোগ্য বলে বিবেচিত নয়। সাধারণ হত্যার ক্ষেত্রে নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীগণ যদি হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দেয় (অর্থের বিনিময়ে বা অর্থ ছাড়াই) তবে হত্যকারীরর মৃত্যুদন্ড হবে না, কিন্তু এই হত্যা যদি ‘আলহিরাবাহ’-এর আওতাভুক্ত হয়, তখন ঐ ব্যক্তির শাস্তি অবধারিত হয়ে যায়। নিহত ব্যক্তির স্বজনেরা ক্ষমা করে দিলেও সে নিস্তার পাবে না; বরং ঐ দন্ড তাকে ভোগ করতেই হবে।

জান-মালের ক্ষতি না করলেও শাস্তি
কুরআনুল কারীমে ‘আলহিরাবাহ’-এর সর্বনিম্ন শাস্তির কথা বলা হয়েছে এভাবে-

“অর্থাৎ তাদেরকে এলাকাছাড়া করা হবে।“

এটি ঐ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যখন কোনো দৃষ্কৃতিকারী কারো জান-মালের ক্ষতি করেনি কিন্তু সে জনগণের মাঝে ভীতির সঞ্চার করেছে এবং সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে। এ ধরনের ক্ষেত্রে অপরাধীকে নিজ এলাকা থেকে অনেক দূরের কোনো কারাগারে নিক্ষেপ করা হবে। এবং একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আপনজন থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা হবে। অতপর তার আচার-আচরণ ও চারিত্রিক অবস্থা বিবেচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আমাদের সমাজে বর্তমানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী ও অন্যান্যদেরকে যেভাবে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে, চাঁদা দাবি করা হচ্ছে যদি তাদের ক্ষেত্রে এ শাস্তির যথাযথ প্রয়োগ হত তাহলে মানুষ হয়ত শান্তিতে ঘুমাতে পারত।

তিনটি উদ্দেশ্যে শাস্তি

কুরআন শরীফ ও সুন্নতে নববী অধ্যয়ন করলে বুঝে আসে যে, শরীয়ত ফৌজদারী দন্ডবিধিগুলোকে কঠোর করেছে মূলতঃ তিনটি বিষয় নিশ্চিত করা
(১) জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য
(২) শাসন ব্যবস্থা সুদৃঢ় করা
(৩) নাগরিকদেরকে সচ্চরিত্রবান ও বিপথগামী হওয়া থেকে রক্ষা করা।

দয়াময় মেহেরবান আল্লাহ সে জন্যেই কুরআন মাজীদে ‘আলহিরাবাহ’ তথা সন্ত্রাস ও বিশৃঙ্খলার কঠোর শাস্তি বিধান ঘোষণার পূর্বে মানব জাতিকে এর তাৎপর্য বুঝাতে গিয়ে বলেছেন :

‘‘যে ব্যক্তি কোনো একটি মানব প্রাণকে কোনো হত্যার বিনিময় বা সন্ত্রাসের অপরাধ ছাড়া হত্যা করল সে যেন পুরো মানব জাতিকেই হত্যা করে দিল। পক্ষান্তরে যে কোনো একজন মানবের প্রাণ রক্ষা করল সে যেন পুরো মানব সম্প্রদায়কেই বাঁাচিয়ে রাখল।’’ (সূরা আলমায়িাদা : ৩২)

কুরআনে এক্ষেত্রে نفسا (নাফসান) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। যার অর্থ, যে কোনো প্রাণ। এখানে ধনী-গরীব, শিক্ষিত-নিরক্ষর, ক্ষমতাবান-সাধারণ লোক এমনকি মুসলিম ও অমুসলিমেরও পার্থক্য করা হয়নি। সকল মানুষ আল্লাহর বান্দা। তাদের সকলের শান্তিপূর্ণভাবে আল্লাহর দুনিয়ায় বসবাসের অধিকার রয়েছে। এই দৃষ্টিতে সকল মানুষের জান-মাল ও ইজ্জতের মূল্য সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর কাছে সমান। দুনিয়ার মানুষের দৃষ্টিতে সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকের হত্যার শাস্তিও দেশের সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ একজন নাগরিকের হত্যার শাস্তির সমপর্যায়ের, তাতে এতটুকুও অবহেলা করা যাবে না বা কম গুরুত্ব দেওয়া যাবে না। কারণ এমনটি করার অর্থই হবে সমাজে হিংসা, বিদ্বেষ ভীতি ও অসহায়ত্ব সৃষ্টি করা। যা একসময় আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার মত পরিবেশ সৃষ্টি করে। সমাজ ও জনপদে বিস্তার করে অনিরাপত্তার পরিস্থিতি এবং শাসকদের উপর সৃষ্টি হয় চরম অবিশ্বাস।

সূরা আল বাকারায় (আয়াত ১৭৯) আল্লাহ তাআলা হত্যকারীদের মৃত্যুদন্ডকে ‘জীবন’ বলে আখ্যা দিয়েছেন-
 
" হে জ্ঞানী! ব্যক্তিরা তোমাদের জন্য কিসাস (হত্যার মোকাবিলায় হত্যা) এ রয়েছে জীবন। যেন তোমরা মুত্তাকী হতে পার (সকল প্রকারের অনিষ্ট থেকে বেঁচে থাকতে পার)।’’

যেহেতু সাধারণ স্তরের বোধ-বুদ্ধির মানুষের জন্য হত্যাকে ‘জীবন’ হিসেবে অনুধাবন করতে কষ্ট হবে তাই আল্লাহ এখানে জ্ঞানী ও বুদ্ধিমানদেরকে সম্বোধন করেছেন। কিন্তু অশ্চর্যের ব্যাপার হল, আমরা নিজেদের আজান্তেই অনেক সময় নিজেকে মহাজ্ঞানী ভেবে বসি। এবং ভালভাবে পড়াশোনা না করে এবং না বুঝেই আল্লাহর বিধানের সমালোচনা শুরু করে দেই।

বিশ্ব মানবতার শান্তির দূত রাহমাতুল লিলআলামীন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: তুমি তোমার ভাইকে সাহায্য কর যখন সে জুলুম করছে তখন এবং যখন সে অন্যের জুলুমের শিকার তখন। সাহাবায়ে কেরাম জানতে চাইলেন মজলুম তথা অত্যাচারিতকে সাহয্যের কথাতো বুঝলাম, কিন্তু জালিমকে সাহায্য করার অর্থ কি? ইরশাদ হল, জালিমকে তার জুলুম ও অনিষ্ট থেকে বিরত রেখে তাকে সাহায্য করবে। (দ্র. সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬৯৫২; জামে তিরমিযী, হাদীস : ২২৫৫)

আজকে আমরা পদে পদে পক্ষ নিচ্ছি জালিমের। মজলুমের কিছু না করে পৃষ্ঠপোষকতা করছি অত্যাচারীর। কিন্তু ভেবে দেখছি না যে, তা দেশ, জনগণ এমনকি জালিমদের জন্যও আত্মঘাতী হচ্ছে। কারণ এভাবে অন্য অনেক লোক হত্যা, সন্ত্রাসে উৎসাহী হয়ে উঠবে এবং এ জালিমরাও সংশোধন হবে না। ফলে সমাজ হয়ে উঠবে আরো অনিরাপদ। বিপথগামীরাও পাবে না সৎ পথের সন্ধান।

একটি ফৌজদারী আইনে দন্ডপ্রাপ্ত একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির পক্ষে শুপারিশ নিয়ে কিছু লোক রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে এলে তিনি রাগান্বিত হয়ে বলেছেন : তোমরা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত শাস্তির বিষয়ে আমার কাছে সুপারিশ নিয়ে এসেছে :

“আল্লাহর শপথ! যদি মুহাম্মাদের মেয়ে ফাতিমাও (রা.) চুরি করত আমি তার হাত কেটে দিতাম। (দ্র. সহীহ মুসলিম, হুদূদ অধ্যায়, হাদীস : ১৬৬৮; সহীহ বুখারী, হাদীস : ৩৭৩৩)”

বেহেশতী নারীদের সর্দার মহিয়ষী কন্যার ব্যাপারে বিশ্ব জাহানের শ্রেষ্ঠ মানব পিতার উক্তি দেখুন! তথাকথিত সভ্যতার দাবিদার আজকের আধুনিক বিশ্ব কি এমন দৃষ্টান্ত হাজির করতে পারবে?

মোটকথা হত্যাকারী ও সন্ত্রাসী যে দলেরই, যে শ্রেণীর বা গোত্রেরই হোক, যত উঁচু বা নীচু সম্প্রদায়ের হোক কোনোভাবেই তার পৃষ্ঠপোষকতা করা যাবে না। এ ব্যাপারেও কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় সুস্পষ্ট নির্দেশনা এসেছে। (দেখুন : সূরা মায়িদা : ৮; সূরা আনআম : ১৫; সূরা নিসা : ১৩৫)

বিশ্বজিৎ দাসের হত্যকারীরা যেভাবে ক্যামেরার মাধ্যমে চিহ্নিত হয়েছে, বিশ্বাস করুন, দেশে ইসলামী বিধান কার্যকর থাকলে আরো আগেই তাদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়ে যেত। কারণ এধরনের ক্ষেত্রে ইসলামে তদন্ত ও জেরা ইত্যাদির নামে অহেতুক বিলম্বের কোনো সুযোগ নেই।

বিশ্বজিৎ দাসের হত্যাকারীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাক। তাদের শাস্তি দেখে অন্য বিপথগামীরা সৎ পথে ফিরে আসুক, রাষ্ট্র, সরকার, রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, পুলিশ ও বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরে আসুক, নিরাপত্তা ও শান্তি ফিরে আসুক-আমার-আপনার প্রিয় মাতৃভূমিতে মহান আল্লাহর দরবারে এ মুহূর্তে এটিই ঐকান্তিক প্রার্থনা। 

1 comment:

  1. এই বিধান গুলা জাফার ইকবাল কে দেখান দরকার । সে ত বলে বেরাই যে দেশ এ ইসলাম আসলে দেশ আফগানিস্থান হয়ে যাবে । কিন্তু ইসলাম যে কত সুন্দর র কত নিরাপদ সেটা ইসলাম র ভিতরে না ঢুকলে বুঝা যাবে না । এই জিনিস গুলা র প্রচার হওয়া দরকার

    ReplyDelete