আজকের বিশ্বে মিডিয়াযুদ্ধ নামে যে আলোচনাটি তুঙ্গে, এটা কোনো নতুন বিষয় নয়।
এর সঙ্গে মানবসভ্যতার পরিচয় অনেক পুরনো। সমকালীন প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে
প্রতিটি যুগই এ যুদ্ধের কীর্তিতে ভরপুর। গোত্রীয় যুগে এ যুদ্ধ শে’র-কবিতা
আবৃত্তি, অলঙ্কার ও ভাষাশৈলীর জোরে চলত। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা থাকত
শা’য়ের বা কবিদের। প্রত্যেক গোত্র নিজেদের শান-শওকত, শৌর্য-বীর্য
প্রকাশের জন্য কবিদের সহায়তা যোগাত। বরং অধিকাংশ গোত্র কবিদের জীবন-জীবিকার
যাবতীয় দায়-দায়িত্বও গ্রহণ করত। যাতে এ বিষয়ে তারা স্বাবলম্বী হতে পারে,
অন্যের ওপর ভরসা করতে না হয়। প্রশংসা-নিন্দা, উৎসাহ-কুৎসা আরবের সাহিত্যের
বিশেষ উপাদান ছিল, যাকে প্রাচীন যুগের মিডিয়াযুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
উপাদান মনে করা হত।
মিডিয়াযুদ্ধ বলা হয় ওইসব মাধ্যমের দ্বারস' হওয়াকে যার সাহায্যে নিজেদের মত ও
দর্শন অন্যের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়।
নবী করীম সাল্লালাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম প্রচার-মাধ্যমের গুরুত্বকে কখনো অবহেলা করেননি, বরং
মিডিয়াযুদ্ধের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে সে যুগের প্রচলিত প্রচার মাধ্যমকে সময় ও
সুযোগ মতো পূর্ণাঙ্গরূপে ইসলামের দুশমনদের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে
ব্যবহার করেছেন।
ইসলামপূর্ব যুগে কাবার দেয়ালকে সাইনবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
কাফেররা বিভিন্ন কুৎসামূলক কথা রটনা করত। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম ‘রাসূলের কবি’ খ্যাত হযরত হাস্সান বিন সাবেত রা.কে বলতেন, ‘হে
হাস্সান! আল্লাহর রাসূলের পক্ষ থেকে জবাব দাও। আল্লাহ রূহুল কুদস (জিবরাইল)
দ্বারা তোমাকে সাহায্য করবেন।’ নির্দেশ পালনার্থে হযরত হাস্সান বিন সাবেত
রা. নিজের ইলহামী কাসীদার সাহায্যে কাফের-মুশরিক ও ইসলামের শত্রুদের এমন
দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতেন যে, তাদের কয়েক পুরুষ পর্যন্ত তারা একথা ভুলতে পারত
না।
এক বর্ণনায় আছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জন্য মিম্বর
স্থাপন করেছিলেন, যে মিম্বরে দাঁড়িয়ে তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম-এর পক্ষ হতে জবাব দিতেন।
একবার আরবের এক গোত্র নবী করীম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কাব্য ও
বক্তৃতায় মোকাবেলার চ্যালেঞ্জ করে বসল। রাসূলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন। তিনি ‘রাসূলের কবি’ খ্যাত হযরত
হাস্সান বিন সাবেত রা. এবং ‘খতীবে রাসূল’ খ্যাত সাম্মাস বিন কায়েস রা.কে
মোকাবিলার জন্য নির্বাচন করলেন। দু’জনই কবিতা আবৃত্তি ও বাকশৈলীর
চিত্তাকর্ষক প্রদর্শনী করলেন। মুসলমান কবি ও বক্তার শ্রেষ্ঠত্ব সবাই
স্বীকার করে নিল।
উমরাতুল কাযার সময় যখন রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহরামের হালতে
তাঁর প্রতি প্রাণ উৎসর্গকারী সাহাবায়ে কেরামকে সঙ্গে নিয়ে মক্কা
মুকাররমায় প্রবেশ করছিলেন তখন রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে
সামনে চলে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা বীরত্বের সঙ্গে কিছু কবিতা আবৃত্তি
করতে লাগলেন। ওই পংক্তিগুলোতে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদব ও
সম্মানের প্রসঙ্গ যেমন ছিল তেমনি কাফেরদের প্রতি ধমকিও ছিল। ওমর রা.
তাঁকে বারণ করার চেষ্টা করলেন। নবী করীম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বললেন, ‘হে ওমর! তাঁকে কবিতা আবৃত্তি করতে দাও। এটা ওই লোকদের ওপর তীর
ছুঁড়ে মারার চেয়েও বেশি কার্যকরী।’ দুশমনের নাকের ডগায় পৌঁছে তাদেরকে
ভীত-সন্ত্রস- করে তোলার এর চেয়ে সুন্দর পদ্ধতি আর কী হতে পারে! কেননা
হুদাইবিয়ার চুক্তিপত্রে ‘অস্ত্র প্রদর্শনীর’ ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল, কিন্তু
‘কবিতা আবৃত্তির’ ওপর কোনো বাধা ছিল না।
প্রচারণার প্রচলিত ও সহজলভ্য
পদ্ধতি ব্যবহারের পাশাপাশি নবী করীম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘ইহুদী
প্রচার-মাধ্যম’ এর প্রতিরোধের প্রতিও বিশেষ গুরুত্ব দিতেন।
কাব ইবনে আশরাফ ইহূদী প্রোপাগান্ডার এক শক্তিশালী ভিত ছিল। তার যেমন অঢেল
সম্পদ ছিল তেমনি সে ছিল একজন কবি। নারীদের অবাধ ও স্বেচ্ছাচারী স্বাধীনতা
আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তাকে গণ্য করা যায়। কবিতায় মুসলিম নারীদের
নাম ধরে ধরে কুৎসা রটাত। রিসালাতের প্রতি কটূক্তিকারীদের আশ্রয়স্থল ও
সাহায্যকারীও ছিল সে। বুদ্ধিবৃত্তিক সহায়তা দান এবং মক্কার কাফেরদেরকে
সংঘবদ্ধ করার জন্য মক্কা মুকাররমা চষে বেড়াত। কাফেরদের সমাবেশে আল্লাহ ও
তার রাসূলের প্রতি কটূক্তি করে কবিতা পাঠ করে শোনাত। নবী করীম সাল্লালাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে হযরত মুহাম্মদ ইবনে সালামা রা. ওই অভিশপ্তকে
খতম করেন এবং চিরদিনের জন্য তার মুখ বন্ধ করে দেন।
ইহূদী আবু রাফে ‘কুফুরী সাংবাদিকতার’ (এটাকে যদি সাংবাদিকতা বলা হয়) সবচেয়ে
বড় আর্থিক সহায়তাকারী ছিল। ইসলামের বিরুদ্ধে পানির মতো পয়সা ব্যয় করতো।
অসৎ ও উত্তেজনা সৃষ্টিকারী কবিদের সেবায় দিরহাম-দিনারের থলি পৌঁছে দিত। সে
কবিরা যেন জীবন-জীবিকার দিক থেকে সম্পূর্ণ দুশ্চিন্তামুক্ত হয়ে ইসলাম ও
মুসলমানদের বিরুদ্ধে মিডিয়াযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে পারে এর সব ব্যবস্তা সে করে
দিত। দীনী জযবায় উজ্জীবিত কয়েকজন নও মুসলিম তাকেও তার চিরস্থায়ী ঠিকানা
জাহান্নামে পাঠিয়ে দেন। রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন এ সংবাদ
পেলেন অত্যন্ত আনন্দ প্রকাশ করলেন এবং ওই ভয়াবহ শত্রুকে যারা জাহান্নামে
পাঠিয়েছেন তাদের কামিয়াবীর জন্য দুআ করেছেন।
শেষোক্ত দু’টি ঘটনার ক্ষেত্রে ইসলামবিরোধী প্রোপাগাণ্ডা ছাড়াও ছিল
ইসলামবিরোধী অব্যাহত ষড়যন্ত্র এবং শান্তিপূর্ণ সহানস্থানের চুক্তি ভঙ্গের
মতো অমার্জনীয় কিছু উপাদান ও উপলক্ষ্য। তাছাড়াও এসব ঘটনার কারণ ও হেকমত
বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। কিন্তু আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে একথা বলতে পারি, ওই যুগে
প্রচলিত মিডিয়াকে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের উপকার ও
ফায়দার জন্য পূর্ণাঙ্গরূপে ব্যবহার করেছেন। মিডিয়া আগ্রাসন ও ইসলামবিরোধী
প্রোপাগাণ্ডার বিষয়টিকে তিনি সামান্যও এড়িয়ে যাননি বা উপেক্ষা করেননি।
আধুনিক প্রযুক্তি যখন থেকে প্রচার মাধ্যমে উৎকর্ষ সাধন করে এবং বক্তৃতা ও
কবিতা আবৃত্তির পাশাপাশি সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশনের ভূমিকা যুক্ত হয় তখন
থেকে মিডিয়ায় এক বিপ্লব সংঘটিত হয়ে যায়। ঘরের কোণেকোণে পর্যন্ত দুশমনদের
অনুপ্রবেশ ঘটে। এতে মহিলা ও শিশুদের মানসিকতা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়।
মিডিয়ায় ইসলাম ও মুসলমানদের দুশমনদের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম হয়। বর্তমানে
প্রায় পুরো মিডিয়া জগৎটা পশ্চিমা পদলেহী এবং ইহূদী-খৃষ্টানদের এজেন্টে ছেয়ে
গেছে। নগ্নতা ও অশ্লীলতাকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। মানবিক
মূল্যবোধের ধারণাটাই তারা পাল্টে দিয়েছে। মিথ্যাকে সত্য এবং বাতিলকে হক
বানিয়ে পেশ করা হচ্ছে।
বাণিজ্যিক রেডিও-টেলিভিশনগুলো সংবাদের শুরুতে এবং
সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় অথবা সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় কুরআনের কোনো আয়াত অথবা
হাদীসে নববীর তরজমা প্রচার বা প্রকাশ করে সাধারণ মানুষের মনে সান্ত্বনা
দেওয়ার চেষ্টা করছে যে, পুরো সংবাদ অথবা পুরো প্রোগ্রামে ইসলামের স্পিরিট
ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। ইসলামের লেভেল লাগিয়ে দেওয়ার পর চাই উগ্র বিনোদনের
পৃষ্ঠাসহ অনেক কিছু ইসলামের খাতায় সংযুক্ত হয়ে যায়।
মিডিয়ায় ইসলাম ও মানবিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে একতরফা যুদ্ধ চলছে। সাংস্কৃতিক
দুর্বৃত্তরা ভদ্রতা ও মানবিকতার চেহারা ঢেকে অশ্লীলতা ও নির্লজ্জতার
প্রবাহে ভেসে যাচ্ছে। মানবতাবিধ্বংসী কালচারে আজ ছেয়ে যাচ্ছে চারদিক।
অন্যদিকে ‘ধর্মীয় সাংবাদিকতা’ মাদরাসার মুখপত্র এবং মাসিক দীনী কিছু
সাময়িকী পর্যন্ত এখনও সীমাবদ্ধ। তবে দীনী পত্র-পত্রিকা ও মিডিয়াগুলো শত
সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ভালো দৃষ্টান- কায়েম করে যাচ্ছে। কাজ
করার মতো সুচারু চিন্তা ও সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন লোক অপেক্ষাকৃত
গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্বে নিয়োজিত। আমাদের পত্রিকাগুলো এখনও নির্দিষ্ট
গণ্ডিতে আবদ্ধ। তবে ইসলামের পুনর্জাগরণের
স্বপ্নচারীদের এ ময়দানে আরো অনেক কিছু করার প্রয়োজন রয়েছে। রেডিওসহ গোটা
ইলেক্ট্রনিক চ্যানেলগুলোতে ইতিবাচকভাবে ইসলামের আওয়াজ প্রচার করার জন্য
কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের বিশাল জগতও ইসলামপন্থীদের
থেকে ফাঁকা পড়ে আছে। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা লুটছে ইহূদী-খৃষ্টান এবং
মুসলিম সমাজে নিয়োজিত তাদের এজেন্টরা। এর বিপরীতে ওলামায়ে কেরামের
প্রভাববিস্তারকারী কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই বললে অত্যুক্তি হবে না। ইসলাম ও
মুসলমানদের জন্য কিছু করার মানসিকতা পোষণকারীদেকে এ ক্ষেত্রটি সম্পর্কে আরো
বেশি করে ভাবতে হবে।
মিডিয়া কে কি ইস্লামিক ভাবে উপস্থাপন করা যায় না ? মিডিয়া অনেক বড় ভুমিকা রাখতে পারে । আমাদের সবার এগিয়ে আসতে হবে তাহলে হয়ত সম্ভব ।
ReplyDelete